নজিরবিহীন ‘গণ’-সাসপেন্ড, সংসদে বিরোধী সাংসদ খেদাও অভিযান!

তিন দিনে সংসদ থেকে সাসপেন্ড ১৪১ সাংসদ। 

নিজস্ব প্রতিবেদন: তিন দফায় সংসদ থেকে সাসপেন্ড ১৪১ জন বিরোধী সাংসদ। শুক্রে ১৪, সোমে ৭৮, মঙ্গলে ৪৯। পুরো শীতকালীন অধিবেশনের জন্যই সংসদ থেকে সাসপেন্ড রাজ্যসভা ও লোকসভা মিলিয়ে এই ১৪১ সাংসদ। কার্যত বিরোধী খেদাও অভিযান চালাচ্ছে সরকার পক্ষ। সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক অধিবেশনে এত সংখ্যক সাংসদের সাসপেন্ড করার নজির নেই। কণ্ঠরোধের চূড়ান্ত নজির, একনায়কতন্ত্র, ড্রাকোনিয়ান সিদ্ধান্তের মতো যত রকম কড়া ভাষায় সম্ভব মোদী সরকারকে আক্রমণ করছে বিরোধীরা। শাসক পক্ষের পাল্টা যুক্তি, বেনজির বিক্ষোভ, হট্টগোল, অসংসদীয়, অশোভন ও সংসদীয় প্রথার পরিপন্থী আচরণ করে চলেছেন বিরোধী সাংসদরা। সেই কারণেই এমন সিদ্ধান্ত। শাসক-বিরোধী তরজার পারদও তুঙ্গে উঠেছে। 

ঘটনার সূত্রপাত ১৩ ডিসেম্বর। ২০০১-এ ভয়ঙ্কর জঙ্গি হানার স্মৃতি উস্কে সংসদে ঢুকে পড়েন দুই যুবক। গ্যালারি থেকে লাফ দিয়ে একেবারে সাংসদদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এক ডেস্ক থেকে অন্য ডেস্কে লাফিয়ে লাফিয়ে কার্যত ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার মতো আচরণ ছিল দুই যুবকের। তার পর জুতোর মধ্যে লুকিয়ে আনা স্মোক ক্যানিস্টার ফাটিয়ে লোকসভা কক্ষের অভ্যন্তরে হাঙ্গামা বাধিয়ে দেন দুই যুবক। একই সময়ে সংসদের
বাইরেও নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করেন এক যুবক এবং এক তরুণী। স্মোক ক্যানিস্টার ফাটিয়ে তানাশাহি নেহি চলেগা স্লোগান দিতে থাকেন। তাঁদের আটক করে পুলিস। সংসদের অভ্যন্তরেও দুই যুবককে পাকড়াও করেন সাংসদরা। সেখানেই চলে উত্তমমধ্যম। তার পর তুলে দেওয়া হয় পুলিসের হাতে।

এই ঘটনার পর থেকেই মোদী সরকারকে আক্রমণে সোচ্চার বিরোধীরা। ঘটনায় মূলত তিনটি দাবি তোলেন বিরোধী সাংসদরা। প্রথম, সংসদে মোদী-শাহ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিবৃতি দিতে হবে। দ্বিতীয়, সংসদে আলোচনা করতে হবে। তৃতীয়, যে বিজেপি সাংসদের পাশ নিয়ে দুই যুবক ঢুকেছিলেন, তাঁকে সাসপেন্ড করতে হবে। কিন্তু সরকার পক্ষ তা মানতে নারাজ। রাজ্যসভা বা লোকসভা, বিরোধীদের কোনও দাবিই মানতে চাননি লোকসভার স্পিকার বা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান। বিরোধীরাও অধিবেশন অচল করতে তেড়েফুড়ে ময়দানে নামে। ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ, প্ল্যাকার্ড হাতে মোদী-শাহের বিরুদ্ধে স্লোগান, এমনকি, রাজ্যসভায় চেয়ারম্যানের চেয়ারের কাছে গিয়ে পর্যন্ত বিক্ষোভ হয়েছে। তার জেরেই এমন বেনজির সিদ্ধান্ত। 

শুক্রবার রাজ্যসভা থেকে তৃণমূলের ডেরেক ওব্রায়েন এবং লোকসভা থেকে সাসপেন্ড করা হয় ১৩ জন সাংসদকে। এর মধ্যে ছিলেন কংগ্রেস, ডিএমকে, সিপিআই এবং সিপিএমের সাংসদরা। শনি-রবি সংসদ বন্ধ। সোমবার অধিবেশন খোলার পর ফের বিরোধীদের হই হট্টগোল শুরু হয়। দিনের শেষে লোকসভা থেকে ৩৩ এবং রাজ্যসভা থেকে ৪৫ জন মিলিয়ে মোট ৭৮ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়। তার মধ্যে সবেচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা অধীর চৌধুরী। বাংলার তৃণমূল কংগ্রেসের কল্যাণ বন্দ্য়োপাধ্য়ায়, অপরূপা পোদ্দার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল মণ্ডল, সৌগত রায়, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, প্রতিমা মণ্ডল, অসিত মাল, শতাব্দী রায়কে সাসপেন্ড করেছেন স্পিকার ওম বিড়লা। এ ছাড়া এই তালিকায় রয়েছেন ডিএমকের তিন সাংসদ টিআর বালু, এ রাজা এবং দয়ানিধি মারান। মঙ্গলবার লোকসভা থেকে সাসপেন্ড হওয়া ৪৯ জনের মধ্যে রয়েছেন কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারি, তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, মালা রায়, মৌসম বেনজির নুর, সুখেন্দুশেখর রায়, কংগ্রেসের শশী তারুর, মণীশ তিওয়ারি, ফারুক আবদুল্লার মতো সাংসদরা। 

দুই ইউপিএ জমানাতেই সংসদে হই হট্টগোল, হাঙ্গামা হয়েছে। কিন্তু সাসপেনশনের মতো ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবেই এককাট্টা বিরোধীরা। অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, সংসদকে বিরোধীশূন্য করে, বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করে বিল পাস করাতে চাইছে। শশী থারুর বলেন, এবার সংসদীয় গণতন্ত্রের শোকগাথা লিখতে শুরু করতে হবে। 

অন্যদিকে মোদী আগেই সংবাদ মাধ্যমে মুখ খুলেছেন। সোমবার সংসদীয় দলের বৈঠকেও বিরোধীদেরই কাঠগড়ায় তুলে বলেছেন, সংসদে যাঁরা হামলা চালিয়েছে, তাঁদেরকেই সমর্থন করছেন বিরোধীরা। এটা সংসদে হানার মতোই ভয়ঙ্কর। এটা দুর্ভাগ্যজনক। 

লোকসভায় মোট আসন ৫৪৩। তার মধ্যে বিজেপির সাংসদ সংখ্যা ৩২৩। ২১টি আসন ফাঁকা রয়েছে। বিরোধী সাংসদ ২১৯। তার মধ্যে তিন দিনে সাসপেন্ড হয়েছেন, ৯৫ জন। অর্থাৎ ৪৩ শতাংশেরও সাংসদ সাসপেন্ড। অন্য দিকে রাজ্যসভায় মোট আসন ২৪৫। এর মধ্য়ে ৭টি আসন ফাঁকা। শাসক দলের সাংসদ সংখ্যা ১০৯। ১২৯ জন বিরোধী সাংসদ। রাজ্যসভা থেকে মোট সাসপেন্ড ৪৬ জন। শতাংশের হিসেবে যা প্রায় ৩৬%। রাজ্যসভায় বিরোধীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে লোকসভায় পাশ হলেও রাজ্যসভায় গিয়ে আটকে যেতে পারে বিল। কিন্তু রাজ্যসভায় ৪৬ সাংসদ সাসপেন্ড হওয়ায় এবার আর বিল পাশ করাতে অসুবিধা হবে না। কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাশ হয়ে যাবে বিল। বিরোধীদের অভিযোগ, সেই উদ্দেশ্যেই এভাবে কার্যত গণ হারে সাসপেন্ড করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই সংসদীয় রাজনীতিতে গুঞ্জন, এই অধিবেশনেই দণ্ড সংহিতা বিল পাশ করিয়ে নিতে পারে মোদী সরকার।