মমতার সঙ্গে দেখা হয়েছিল জ্যোতিবাবু-বুদ্ধবাবুর! তবু শুভেন্দুর সাক্ষাৎ বিরলের মধ্যে বিরলতম!

বিধানসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) শুভেন্দু অধিকারীর (Suvendu Adhikari) সাক্ষাৎ ঘিরে জল্পনার অন্ত নেই। অলঙ্করণ: সুবর্ণরেখা টিম   
নিজস্ব প্রতিবেদন: বাংলার রাজনীতিতে হঠাত্‍ই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে সৌজন্য শব্দটা। রাজ্য বিধানসভায় (West Bengal Assemble) মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Benerjee) ঘরে তিন বিধায়কের সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীর (Suvendu Adhikari) প্রবেশ, সামান্য বাক্য বিনিময় এবং তা নিয়েই হাজারো জল্পনা। তবে ঘোর কাটল পরের দিনই। বিধানসভার ওই সৌজন্য যে শুধুই সৌজন্য, এবং তার সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধিতার কোনও জায়গা নেই, সেটা বোঝাতে বিরোধী দলনেতা সময় নিলেন মাত্র ২৪ ঘণ্টা। গাইঘাটার ঠাকুরনগরে ঠাকুরবাড়ি থেকে আরও বাড়ালেন আক্রমণের ঝাঁঝ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন শুভেন্দু। 

ব্যাপারটা ছিল নিতান্তই সাধারণ। ২৬ নভেম্বর সংবিধান দিবস। শনিবার হওয়ায় তার আগের দিনই বিধানসভায় এই দিনটি উপলক্ষে আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়। অধিবেশন চলছিল। মুখ্যমন্ত্রী মার্শালের মাধ্যমে বিরোধী দলনেতাকে বার্তা পাঠান যে চাইলে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে দেখা করতে পারেন শুভেন্দু। আবেদনে সাড়া দিয়েও শর্ত দেন শুভেন্দু। তাঁর সঙ্গে তিন বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পল, মনোজ টিগ্গা এবং অশোক লাহিড়ীকে সঙ্গে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে যান। নমস্কার বিনিময়ের পর শুভেন্দুকে ভাই বলে সম্বোধন করে বলে সূত্রের খবর। কুশল বিনিময়ও হয়। শুভেন্দুর বাবা শিশির অধিকারীর সম্পর্কেও মুখ্য়মন্ত্রী খোঁজ নেন বলে বিধানসভা সূত্রের খবর। যুযুধান দুই প্রতিপক্ষের এই নিতান্ত সাদামাটা সাক্ষাৎকারই এখন রাজ্য রাজনীতির হট কেক। বিস্তর জল্পনা, জলঘোলা। 

অথচ গণতন্ত্রে এমন ছবি বিরল হওয়ার কথা নয়। বরং গণতন্ত্র রাজনৈতিক বিরোধিতা প্রকাশের স্বীকৃত মঞ্চ এবং তার জন্য রাজনীতিবিদদের সামাজিক বা গণতান্ত্রিক আচরণে সৌজন্য প্রকাশের বিস্তর অবকাশ রয়েছে। কিন্তু রাজ্য বা দেশে এমন সংস্কৃতি বিরল বলেই মুখ্যমন্ত্রী-বিরোধী দলনেতার সহাবস্থান স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। এমনকি, সরকারি অনুষ্ঠানেও বিরোধী বিধায়ক-সাংসদদের আমন্ত্রণ না জানানো বা জানালেও অনুপস্থিতিই প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি। 

জ্যোতি বসু-মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাক্ষাৎ

দীর্ঘ বাম জমানায় বহু আন্দোলন করেছেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যুব কংগ্রেস নেত্রী হিসেবে বা ১৯৯৮-এ তৃণমূল প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলনেত্রী হিসেবে বহু প্রতিবাদ-বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, তীব্র আন্দোলনের জন্যই তাঁকে বাংলার অগ্নিকন্যা বলতেন অনেকে। বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল, এমন কথা বলতে পারেন না রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তবে এটা ঠিক যে রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা হলেও জ্যোতি বসু এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরস্পরকে সম্মান করতেন। আর মমতা-শুভেন্দুর মতো এমন সৌজন্যের ছবি বলতে এখনও পর্যন্ত কার্যত একটাই মনে পড়ছে। ২০০৭ সাল। সিঙ্গুরে জমি আন্দোলন তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই পরিস্থিতিতেই ২০০৭ সালের ৪ জুন সল্টলেকে জ্যোতিবাবুর বাসভবনে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’জনের কথাও হয়। যদিও জ্যোতিবাবু তখন মুখ্যমন্ত্রী নন। মমতা নিজেও বিরোধী দলনেত্রী নন। তখন বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়। 

২০০৭ সালের ৪ জুন সল্টলেকে জ্যোতিবাবুর বাসভবনে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সোশাল মিডিয়া থেকে নেওয়া

তার প্রায় এক বছর পর ২০০৮ সালের ২০ আগস্ট মুখোমুখি হয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং সেই সময়ের বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। রাজভবনে সিঙ্গুর ইস্যুর মধ্যস্থতা করতে চেয়ে দু’পক্ষকে এক মঞ্চে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন এ রাজ্যের তৎকালীন রাজ্যপাল গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী। তাঁর মধ্যস্থতায় দীর্ঘ আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত সেই বৈঠক ব্যর্থ হয়।

আরও পড়ুন: তৃণমূলের দুর্গম গিরি! অখিলবাণীর বিড়ম্বনা কাটাতে পারবে জোড়াফুল?

এর বাইরে এক মঞ্চে দূরে থাক, দীর্ঘ ৩৪ বছরে বিধানসভার অধিবেশন কক্ষ বাদ দিলে মমতা-জ্যোতিবাবু বা মমতা-বুদ্ধবাবু এক জায়গায় দেখা গিয়েছে এমন ছবিও মনে করতে পারছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তার জন্য কোনও এক পক্ষের দোষ দেওয়াও যায় না। কার্যত শাসক-বিরোধী উভয় পক্ষেরই ছিল অনমনীয় মনোভাব। 

মহাকরণে মমতার চুলের মুঠি বিতর্ক 

বরং বঙ্গ রাজনীতির ইতিহাসে একাধিক ঘটনা শাসক-বিরোধী চরম অসহিষ্ণুতার উদাহরণ রয়েছে। গত শতকের নয়ের দশক। মমতা তখন কংগ্রেসে। প্রতিবাদী মুখ বিরোধী নেত্রী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন রাজ্য রাজনীতিতে। নদিয়ার ফুলিয়ায় ধর্ষিতা তরুণীর বিচার চেয়ে মহাকরণে ধর্নায় বসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মহাকরণ থেকে তাঁকে চুলের মুঠি ধরে বাইরে বের করে দিয়েছিল জ্যোতি বসুর পুলিস। 

২১ জুলাইয়ের কালো দিন

আবার ১৯৯৩-এর ২১ জুলাই কলকাতার রাজপথে গুলি চলেছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যুব কংগ্রেসের আন্দোলনে সেদিন পুলিসের গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল ১৩ জনের। এখনও সেই একুশ জুলাই স্মরণ করে তৃণমূল। সভা হয় ধর্মতলায়। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে সেই ঘটনাও এক কলঙ্কিত অধ্যায়। 

মমতার ‘সৌজন্য’

অথচ সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর একাধিক বার সৌজন্যের রাজনীতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। অসুস্থ জ্যোতিবাবুকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়া থেকে শুরু করে অসুস্থ বুদ্ধবাবুকে দেখতে তাঁর পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে যাওয়া, নবান্নের বৈঠকে বিমান বসুদের ফিশ ফ্রাই খাওয়া,মমতা-বাবুল ঝালমুড়ি খাওয়া-র মতো বহু নজির রয়েছে। কিন্তু এগুলিকে রাজনৈতিক সৌজন্য বলা যায় কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ। বরং এগুলিকে তাঁরা সামাজিক সৌজন্য হিসেবে দেখেন। 

বিরোধীদের অসৌজন্যের নালিশ

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অসৌজন্যের রাজনীতির অভিযোগেই বেশি সরব পদ্ম শিবির-সহ বিরোধীরা। জেলায় জেলায় প্রশাসনিক বৈঠকে বিজেপি বিধায়ক-সাংসদরা ডাক পান না। তা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে বিরোধী শিবিরে। কোনও বৈঠকেও ডাকা  হয় না বলে অভিযোগ। বিধানসভার একাধিক স্থায়ী কমিটিতে বিরোধী পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান করার রীতি। কিন্তু এই সরকার সেই রীতিও অনেক ক্ষেত্রেই মানছে না বলে অভিযোগ গেরুয়া শিবিরের। পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান করে রাখা হয়েছে মুকুল রায়কে। তিনি বিজেপি থেকে জিতে বিধায়ক হলেও পরে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। এ নিয়ে আদালতে মামলাও করেছে বিজেপি। 

কুকথার স্রোত!

আবার পরস্পরকে আক্রমণে ভাষাজ্ঞান হারিয়ে ফেলার নজিরও ভুরি ভুরি। মমতা যেমন নাড্ডা, গাড্ডা, চাড্ডা বলে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতিকে, হোদল কুতকুত বলে আক্রমণ শানিয়েছেন অমিত শাহকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কোমড়ে দড়ি পরিয়ে জেলে ঢোকানোর কথা বলেছেন। উল্টো দিকে শুভেন্দু অধিকারীও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণে বেগম, খালা, লেডি কিম এর মতো বিষেষণ ব্যবহার করেছেন। নাম না করলেও অভিষেককে কয়লা ভাইপো, তোলাবাজ ভাইপো বলে বহুবার বিঁধেছেন। আবার শেষ সংযোজন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে কুরুচিকর আক্রমণ করেছেন রাজ্যের কারা প্রতিমন্ত্রী অখিল গিরি। এছাড়া ছোটখাটো নেতাদের এমন কুকথার কথা বলতে গেলে এই প্রতিবেদন শেষ করা যাবে না। 

আরও পড়ুন: নভেম্বর বিপ্লব! পাখির চোখ পঞ্চায়েত, বাম-ডান সবাই ছুটছে গ্রামে

এই আবহে মমতা-শুভেন্দু সাক্ষাত্‍ অত্যন্ত তাত্‍পর্যপূর্ণ বলেই মনে করেছিল রাজনৈতিক মহল। অনেকেই মনে করেন, আসলে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক সৌজন্যবোধ উধাও হয়ে যাওয়াতেই এই সাক্ষাৎ বিরল বলে মনে হয়েছে। তা নিয়ে এত চর্চা, এত তরজা।

মমতার মাস্টারস্ট্রোক, নাকি অ্যাডভান্টেজ শুভেন্দু?   

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের আবার ব্যাখ্যা, এটা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর মাস্টারস্ট্রোক। শুভেন্দু এড়িয়ে গেলেও বলতে পারতেন, ডাকলেও আসেন না বা সৌজন্য নেই বিরোধী দলনেতার। আবার বৈঠকে যোগ দেওয়াতেই ঘাসফুল শিবিরেরই কার্যত জয় হয়েছে। কারণ, বিজেপি অস্বীকার করলেও দলের অভ্যন্তরের লবিবাজি কারও অজানা নয়। রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং বিরোধী দলনেতার শিবিরের মধ্যে যে সংঘাতের চোরা স্রোত রয়েছে। মুরলি ধর সেন লেনের অলিন্দে কান পাতলে শুভেন্দুর রাজ্য সভাপতি গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে ইদানিং। এমন পরিস্থিতিতে মমতার ঘরে গিয়ে সাক্ষাৎ করায় সুকান্ত-দিলীপ শিবির শুভেন্দুর বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন। দিলীপের যেমন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘ওঁদের পুরনো সম্পর্ক।’’ ফলে কার্যত ঘরে বাইরে চাপে কিছুটা হলেও চাপে পড়েছেন শুভেন্দু। সেই কারণেই সভায় সভায় তাঁকে বুঝিয়ে বেড়াতে হচ্ছে যে, তিনি সৌজন্য দেখালেও বিরোধিতার রাস্তা ছাড়েননি এবং ছাড়বেন না। মমতাকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী করে ছাড়বেন। গাইঘাটায় ঠাকুরবাড়ির সভার পর রবিবার নন্দীগ্রামের ভূপতিনগরে ফের একই কথা বলতে হয়েছে তাঁকে। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী দলনেতার কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছেন বলে বিজেপির কেন্দ্রীয় মুখপাত্র অমিত মালব্য টুইট করে পাল্টা কৌশল নেওয়ার একটা চেষ্টা করেছেন। তবে সেটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি আম জনতার। 

তবে সেটা যাই হোক, মমতা-শুভেন্দুর এই সাক্ষাৎ বাংলার রাজনীতিতে যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, একথা এখনই বলে দিচ্ছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। কারণ, এই ছবি বিরলের মধ্যেও বিরলতম। অতীতে দেখা যায়নি এমনই শুধু নয়, ভবিষ্যতেও এমন দৃশ্যের সাক্ষী থাকবে কিনা বঙ্গ রাজনীতি, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ। আর আমজনতা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক মঞ্চে কুস্তি হলেও অন্তত দোস্তি থাক সাংবিধানিক ক্ষেত্রে, উন্নয়নের প্রশ্নে।