তৃণমূলের দুর্গম গিরি! অখিলবাণীর বিড়ম্বনা কাটাতে পারবে জোড়াফুল শিবির?

রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে (President Draupadi Murmu) নিয়ে অখিল গিরি (Akhil Giri) মন্তব্যে অস্বস্তিতে তৃণমূল (TMC)। অলঙ্করণ: সুবর্ণরেখা টিম
নিজস্ব প্রতিবেদন: অখিল গিরির (Akhil Giri) এক বেফাঁস মন্তব্যেই বেজায় অস্বস্তিতে পড়ে গেল জোড়াফুল। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে (President Draupadi Murmu) নিয়ে রাজ্যের কারা প্রতিমন্ত্রী অখিল গিরির কুরুচিকর মন্তব্যের জল গড়াল বহুদূর। এমন বিড়মম্বনায় পড়েছে তৃণমূল (TMC) যে, না মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে পারল, না বিরোধীদের যোগ্য জবাব দিতে পারল রাজ্যের শাসক দল। পঞ্চায়েত ভোটের আগে এমন লোপ্পা বল পেয়ে উল্লিসত বিরোধীরা। বঙ্গ থেকে দিল্লি, চালিয়ে খেলছেন বিজেপি (BJP) নেতারা। আরও যে বেশ কিছু ওভার বাকি, সূর্যোদয় দেখেই দিনের আঁচ করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। 

সব কিছু মোটামুটি ঠিকঠাকই চলছিল। দুর্নীতি, ডেঙ্গু নিয়ে মূলত বিজেপি এবং কিছুটা বাম-কংগ্রেস সুর চড়াচ্ছিল বটে, কিন্তু অখিল গিরির মন্তব্য নিয়ে যা হল, তা ছাপিয়ে গিয়েছে সব কিছু। শিক্ষা দুর্নীতিতে পার্থর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর দুই ফ্ল্যাট থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা উদ্ধার বাদ দিলে সাম্প্রতিক অতীতে এত বড় অস্বস্তির মুখে পড়তে হয়নি শাসক দলকে। কিন্তু সেসবও প্রায় গুটিয়ে এনেছিল জোড়াফুল শিবির। পার্থকে বহিষ্কার করে, অনুব্রত কিছু করেনি গোছের ভাব করে দলের খুব একটা ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয়নি। কিন্তু কোনও আগাম পূর্বাভাস ছাড়া আচমকাই লুজ বল খেলে ফেললেন অখিল গিরি। 

১০ নভেম্বর নন্দীগ্রামে বিতর্কিত ‘অপারেশন সূর্যোদয়’-এর বর্ষপূর্তি ঘিরে কম জলঘোলা হয়নি। কুণাল ঘোষের নেতৃত্বে স্মরণসভা করে তৃণমূল। সেই সভাতেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চলে আসে মঞ্চে। কোন গোষ্ঠী মঞ্চে থাকবে, কোন গোষ্ঠী থাকবে না, তাই নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে কার্যত হাতাহাতির পরিস্থিতি তৈরি হয়। কুণাল ঘোষ কোনওক্রমে সামাল দিয়ে প্রায় নমো নমো করে আর বাক্যবাণে শুভেন্দু অধিকারীর ‘আদ্যশ্রাদ্ধ’ করে সেই সভা করেন। শুভেন্দুর নেতৃত্বে বিকেলেই আবার বিকেলে পদ্ম শিবিরের স্মরণসভা। রাতে তৃণমূলের স্মরণসভার মঞ্চে আগুন ধরানোর অভিযোগ ওঠে বিজেপির বিরুদ্ধে। যদিও বিজেপি অস্বীকার করে অভিযোগ। কিন্তু তার প্রতিবাদে নন্দীগ্রামে কুণাল, শশী পাঁজাদের ধর্না, অবস্থান। এফআইআর-এ শুভেন্দুর নাম ঢোকানো এবং গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন চলে। ফলে নন্দীগ্রাম ছিল নন্দীগ্রামেই। 

বেফাঁস অখিল গিরি 

সেই ফুটন্ত তেলে যেন জল ছিটিয়ে দিলেন অখিল গিরি। নন্দীগ্রামের এক সভায় বেমক্কা মন্তব্য করে নিজেও বেকায়দায় পড়েছেন, দলকেও বিড়ম্বনায় ফেলে দিয়েছেন রাজ্যের কারা প্রতিমন্ত্রী। শুভেন্দু অধিকারীকে আক্রমণ করতে গিয়ে দেশের সাংবিধানিক প্রধান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে নিয়েই কুমন্তব্য করে বসেছেন। ওই সভার একটি ভিডিও সামনে এসেছে। তাতে অখিল কণ্ঠে শোনা গিয়েছে, ‘‘আমরা রূপের বিচার করি না। তোমার রাষ্ট্রপতির চেয়ারকে আমরা সম্মান করি। তোমার রাষ্ট্রপতিকে কেমন দেখতে বাবা?’’ ওই ভিডিওতেই দেখা গিয়েছে, কুণাল ঘোষও অখিলের কয়েক ফুটের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁকেও বাধা দিতে দেখা যায়নি। 

তৃণমূলকে অলআউট অ্যাটাক বিজেপির

ভিডিওটা খালি ছড়ানোর অপেক্ষা ছিল। এমন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনাকে ইস্যু করতে বিরোধীরা কি আর ছাড়ে? ছাড়েওনি। রাতেই ওই ভিডিও-সহ প্রথম টুইট করে বিতর্কের ঝড় তোলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় মুখপাত্র অমিত মালব্য। তৃণমূলকে ‘আদিবাসী বিরোধী’ তকমা দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পদ্ম শিবির। রাজ্য় থেকে কেন্দ্রীয় নেতারা একের পর এক টুইট, মিডিয়া বাইটে ঝড় তুলতে শুরু করেন। কেন্দ্রীয় আদিবাসী উন্নয়ন মন্ত্রী ও ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মন্ত্রী অর্জুন মুণ্ডা ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন। অখিলের পদত্যাগ দাবি করে তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আদিবাসীদের সম্মান দেয় না, মন্ত্রীর এই মন্তব্য থেকেই তা পরিষ্কার। অখিলের পদত্যাগের দাবিও তোলেন অর্জুন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি থেকে শুরু করে বিজেপির তাবড় কেন্দ্রীয় নেতা-নেত্রীরা একের পর এক বোমা-গুলি ছুড়তে শুরু করেন তৃণমূলকে নিশানা করে। 

আরও পড়ুন: নভেম্বর বিপ্লব! পাখির চোখ পঞ্চায়েত, বাম-ডান সবাই ছুটছে গ্রামে

অখিলের ব্যাকট্র্যাক

অখিলও সকাল হতেই বুঝতে পারেন, জল গড়িয়েছে অনেক দূর। দেরি না করে, (হয়তো দলের নির্দেশেই) নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেন। উত্তেজনার বশে, শুভেন্দুর উস্কানিতে পা দিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন বলে একটি ভিডিও বার্তা দেন। কিন্তু সেই কথাতেও যে চিঁড়ে ভেজেনি, তা বোঝা যায় বেলা গড়াতেই। তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরাই টুইট করে অখিলের মন্তব্য দল সমর্থন করে না বলে টুইট করেন। অর্থাৎ অখিলের থেকে দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেন। সুস্মিতা দেব, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যরা ভিত তৈরি করে দেন। অখিলের সঙ্গে দেওয়াল তোলে তৃণমূল। তৃণমূলের অফিশিয়াল টুইটার হ্যান্ডল থেকেও একই বার্তা দেওয়া হয়। অখিলের মন্তব্য দল সমর্থন করে না বলে লেখা হয় টুইটারে। তার আগেই আবারও হয়তো দলের উপরমহলের নির্দেশে ফের বার্তা দেন অখিল। এবার অবশ্য ভিডিও বার্তা নয়, টিভি চ্যানেলে বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখবেন। 

আদিবাসী-বিরোধী তৃণমূল, আক্রমণে বিজেপি

কিন্তু বন্দুক থেকে গুলি বেরিয়ে গেলে যে আর ফেরত নেওয়া যায় না, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন অখিল। সাত সকালেই সৌমিত্র খাঁ জাতীয় মহিলা কমিশনে চিঠি পাঠিয়ে অখিলের বিধায়ক পদ খারিজের দাবি জানিয়েছেন। কলকাতায় রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছে বিজেপি। নন্দীগ্রামেও প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। রাজভবনের দারস্থ হয়েছেন বিরোধী দলনেতা-সহ বিজেপি বিধায়করা। আগামী বিধানসভার অধিবেশনেও এই ইস্যু নিয়ে যে তোলপাড় হবে, তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে পদ্ম শিবির থেকে। একজোট হয়ে হই হল্লা, অখিলের পদত্যাগ, বিধায়ক পদ খারিজের দাবিতে যে সোচ্চার হবেন বলে এখন থেকেই শুনিয়ে রেখেছেন দলের নেতা-বিধায়করা। আরও কয়েকদিন এই নিয়ে যে তোলপাড় চলবে এবং পঞ্চায়েত ভোটের আগে তৃণমূলকে আদিবাসী ও মহিলা বিরোধী তকমা সেঁটে দিতে যে কোনও পাথরই না নড়িয়ে ছাড়বে গেরুয়া শিবির, তার ইঙ্গিত মিলছে এখন থেকেই।

আরও পডু়ন: চার মাসে ইডি-সিআইডির অভিযানে রাজ্যে উদ্ধার ৮০ কোটি! বাংলা কি সত্যি এতই ধনী?

গা বাঁচানোর চেষ্টা তৃণমূলের!

আর অখিলের দল তৃণমুলের এখন শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা। মুখে না বললেও বিধানসভা ভোটে শুভেন্দু অধিকারীর কাছে দলের সর্বময় কর্ত্রীর হারে কাঁটার মতো বিঁধছে। দাপটের সঙ্গে নন্দীগ্রামে ঘুরছেন শুভেন্দু। ট্যাকল করতে কুণালকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছে তৃণমূল। আর নন্দীগ্রামের মাটিতে দাঁড়িয়ে শুভেন্দুর প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাল লড়াই দিচ্ছেন অখিল গিরি। তাঁর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে গেলে নন্দীগ্র্রামের লড়াইয়ে কিছুটা পিছিয়ে আসতে হয়। তাছাড়া অখিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে পুরোপুই দায় স্বীকার করে নেওয়া হয়। তাই অখিলের মন্তব্যের সময় যিনি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেই কুণালকে দিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করিয়ে শুভেন্দুর দিকেই উস্কানি দেওয়ার অভিযোগের আঙুল তুলে দেওয়া হল। আবার দল ওই মন্তব্য়কে সমর্থন করে না বলে গা বাঁচানোও হল। 

শেষ দেখে ছাড়ার হুঙ্কার বিজেপির

বিরোধী শিবির অবশ্য এত সহজে বাঁচতে দেবে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে শুভেন্দু অধিকারী। রাজভবন, বিধানসভা তো হয়েছেন, আদালতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে জঙ্গলমহল কার্যত উজাড় করে ভোট দিয়েছে বিজেপিকে। উত্তরবঙ্গেও কার্যত তাই। উত্তরে একটাও আসন জোটেনি শাসকের ঝুলিতে। পশ্চিমের জঙ্গলমহলেও প্রায় একই অবস্থা। একুশের বিধানসভা ভোটে ২০০ আসনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মাঠে নেমে ৭৭-এর গণ্ডিতে আটকে গেলেও সেই জঙ্গলমহল এবং উত্তরবঙ্গে তুলনামূলক ভাল ফল বিজেপির। অর্থাৎ আদিবাসী ভোটব্যাঙ্ক। সেই ভোটব্যাঙ্কের ভাবাবেগে আঘাত করেছে তৃণমূল এবং দলের মন্ত্রী, সেটা বুঝিয়ে পঞ্চায়েত ভোটে সেই ভোটব্যাঙ্ক আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে পদ্ম শিবির। টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলবে পঞ্চায়েত ভোট পর্যন্ত। এবং পঞ্চায়েত ভোটে এই মন্তব্য যে হাতিয়ার করবে বিজেপি, তা বোঝাই যাচ্ছে। 

তৃণমূলনেত্রীর মাঠে নামার অপেক্ষা

তৃণমূল নেত্রী অবশ্য এখনও মাঠে নামেননি। পরবর্তী কোনও সভার অপেক্ষা। হয়তো অখিলের বিরুদ্ধে বার্তা দিতে পারেন। অথবা দলের লাইনেই শুভেন্দু বা অন্য পদ্ম নেতারা কীভাবে তাঁকে আক্রমণ করেন, তার ফিরিস্তি শোনাতে পারেন, যেমন শুনিয়েছেন কুণাল ঘোষ। বিধানসভা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী কীভাবে দিদি, ও দিদি... বলেছিলেন রকবাজদের মতো, ইভটিজারদের মতো, শুভেন্দু কীভাবে মমতাকে ‘বেগম’ বলে একটি সম্প্রদায়কে জুড়ে আক্রমণ শাানান, সেসব উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে কুণালের দাবি, অখিলকে আক্রমণ করা বিজেপির সাজে না। 

কিন্তু পঞ্চায়েতের কঠিন পিচে এমন ডিফেন্সিভ খেলে উইকেট রক্ষা হবে কি? কারণ শিক্ষায় নিয়োদ দুর্নীতি কার্যত প্রমাণিত। সল্টলেকে রাতারাতি টেনে্ হিঁচড়ে আন্দোলনকারীদের তুলে দেওয়া থেকে পুলিসের কামড়কাণ্ডে পুলিস প্রশাসনের বিরুদ্ধে জনমানসে ক্ষোভ রয়েছে। দীর্ঘদিনের শাসনে স্বাভাবিকভাবে অ্য়ান্টি ইনকামবেন্সি বা প্রশাসন-বিরোধী ক্ষোভ তৈরি হয়, সেটাও রয়েছে। কিন্তু তৃণমূল দলে মমতা ম্যাজিক বলে একটা কথা রয়েছে। সারদা থেকে একের পর এক চিটফান্ডের ধাক্কা সামলেছেন, নারদ ঘুষকাণ্ড উতরেছেন আগে জানলে প্রার্থী করতাম না বলে, উনিশের লোকসভা একুশের বিধানসভার বৈতরণীও সসম্মানে পার করেছেন। এক এক সময়ে একটা মাস্টারস্ট্রোকে ফিরে এসেছেন স্বমহিমায়। তাই বিজেপির কাছে ঘুরিয়ে পাল্টা প্রশ্নটা করা যায়, হাতে এত বাউন্সার, ইয়ার্কার, গুগলি থাকতেও পঞ্চায়েতের পিচে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উইকেট ফেলার মতো জায়গায় বিজেপি যেতে পারবে কি?