কামাখ্যা মন্দিরের যোনি পাথর। |
নিজস্ব প্রতিবেদন: মন্দিরে কোনও দেবমূর্তি নয়, পুজো করা হয় নারী যোনির। দেশ বিদেশের তান্ত্রিকরা এই যোনি পুজোকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর অম্বুবাচীর সময় ভিড় করেন মন্দিরে। ধুমধাম করে দেবীজ্ঞানে পুজো করা জীবন্ত নারীর যোনিকে।
অসমের গুয়াহাটি শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ও দিসপুর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে নিলাচল পর্বতে অবস্থিত কামাখ্যা মন্দির। একান্ন শক্তিপিঠের মধ্যে অন্যতম কামরূপ-কামাখ্যা মন্দির। কেউ কেউ বলেন এখানেই মিলিত হয়েছিলেন হর-পার্বতী। আবার কালিকা পুরাণ অনুযায়ী দক্ষযজ্ঞের পর ভগবান শিব যখন পার্বতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করেছিলেন, তখন সতীমাতার যোনির অংশ পড়েছিল নিলাচল পর্বতে। পরে সেখানেই তৈরি হয় কামাক্ষা মন্দির এবং নিয়মিত যোনি পুজোর রীতি চালু হয়। যোনিকেই এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া সমস্ত মানুষের প্রবেশ দ্বার বলে গণ্য করা হয়। তাই এই মন্দিরের যোনি পুজো তন্ত্র সাধনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
মন্দিরের গর্ভগৃহে নেই কোনও মূর্তি। বরং মায়ের যোনি রূপকেই পুজো করা হয় এই মন্দিরে। গর্ভগৃহের বাইরে অবশ্য মায়ের দশ মহাবিদ্যা রূপের পুজো করা হয়। ধূমাবতী, মাতঙ্গী, বগলা, তারা, কমলা, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ভূবনেশ্বরী, কালী এবং ত্রিপুরাসুন্দরী- এই দশ মহাবিদ্যা এখানে অবস্থান করার কারণে কামরূপ-কামাখ্যা মন্দির তন্ত্রশক্তিতে পরিপূর্ণ।
মন্দিরের গর্ভগৃহে মায়ের যোনি পাথর ফুলে ঢাকা থাকে। রহস্যময় ভাবে এই যোনি পাথর থেকে সবসময়ে প্রাকৃতিক জলের প্রবাহ নির্গত হতে থাকে। কিস্তু এই জলের উৎস কী, সে বিষয়ে কোনও উত্তর পাওয়া যায় না। তবে ভক্তদের বিশ্বাস, এই জল সেবন করলে সমস্ত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। প্রতি অম্বুবাচী তিথিতে মা ঋতুমতী হন। আর সেই সময় আশ্চর্যজনকভাবে মায়ের যোনিরূপ থেকে নির্গত জলও লাল হয়ে যায়। ভক্তরা এই লাল জল প্রবাহকে দেবী রজ:স্বলা হয়েছে বলেই মনে করেন। এই সময় তিন দিনের জন্য মন্দিরের দ্বার বন্ধ রাখা হয়। এই তিথিতে মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ব্রক্ষ্মপুত্র নদের জলও লাল হয়ে যায়। ঠিক তিন দিন পর ধীরে ধীরে নদের জল আবার নিজের রঙে ফিরে যায়।
কামাখ্যা মন্দিরের একটি বিশেষ উৎসব হল যোনি পুজো। এই পুজো সম্পূর্ণ করেন এক পুরোহিত। একজন নারীকে দেবীর শক্তিপিঠের ওপর বসিয়ে দেবতা জ্ঞানে পুজো করা হয় এই সময়ে। পুরোহিত মন্ত্র পড়ে পবিত্র জলে নারীর দেহ শুচী করে নিয়ে পুজো আরম্ভ করেন। নারী দেহ থেকে কামরস নির্গত না হওয়া পর্যন্ত চলে পুজো পাঠ। মনে করা হয়, ওই পুজিতা নারীর পবিত্র দেহে মা কামাখ্যা সেই সময়ে অবস্থান করেন তাই ওই নির্দিষ্ট সময়ে তিনি বিশেষ শক্তির অধিকারী হয়ে থাকেন। পুজোর শেষে মানবী দেহে ওই নারী ভক্তদের আশীর্বাদ করেন।
কামাখ্যা মন্দির। |
ভক্তরা বিশ্বাস করেন, এই মন্দিরে মনেপ্রাণে প্রার্থনা জানালে তা পুরণ হয়। মন্দিরের পিছন দিকের দেওয়ালে ভক্তরা তাঁদের মনের কথা বলেন। এই দেওয়ালটিকে মায়ের কান বা কর্ণ সমান বলে মনে করা হয়। মন্দিরের সামনে রয়েছে একটি কুণ্ড। এই কুণ্ডে স্নান সেরে ভগবান গণেশকে পুজো দিয়ে তবেই ভক্তরা মায়ের মন্দিরে প্রবেশ করেন। কুণ্ডটিকে বলা হয় সৌভাগ্য কুণ্ড।
শিব পুরাণ মতে ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে এক অবতার পরশুরাম। বলা হয় পরশুরাম একবিংশ বার ক্ষত্রিয় নিধন করেছিলেন। সেই পাপ থেকে মুক্ত হতে ভগবান শিব পরশুরামকে কামাখ্যার জলে স্নান করে মা কামাখ্যার তপস্যা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই কথা মেনেই পরশুরাম ব্রক্ষ্মহত্য়া, ভ্রুণহত্যা ও সব পাপ থেকে মুক্তি লাভ করেন। তাই এখনও মনে করা হয়, কামাখ্যার সৌভাগ্য কুণ্ডে স্নান করলে সমস্ত পাপ থেকে ভক্তরা মুক্তি পান। তাই আজও মহাশক্তিপিঠ কামাখ্যা ধামের মহিমা মানুষের মুখে মুখে ফেরে। বিশ্বাস করা হয় মায়ের কৃপায় সুখ ও সমৃদ্ধি ঘটে। ভক্তদের মোক্ষপ্রাপ্তি হয়।