নবান্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) ও নীতীশ কুমারের (Nitish Kumar) বৈঠক। |
নিজস্ব প্রতিবেদন, কলকাতা: বিরোধী ঐক্যের জল্পনা আরও উস্কে আজ নবান্নে আসছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার (Nitish Kumar)। নবান্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) সঙ্গে নবান্নে বৈঠক করবেন নীতীশ। বিরোধী ঐক্যের জল্পনার মধ্য়ে নীতীশের কলকাতা সফর ঘিরে বাড়ছে রাজনৈতিক কৌতূহল। চব্বিশের লোকসভা ভোটের আগে দুই মুখ্যমন্ত্রী তথা জেডিইউ এবং তৃণমূল কংগ্রেসের এই বৈঠক রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
বছর ঘুরলেই লোকসভা ভোট। কিন্তু মাসখানেক আগেও বিজেপি বিরোধী দলগুলি ছিল কার্যত ছন্নছাড়া। কংগ্রেস বিরোধী দলগুলিকে এক ছাতার তলায় আনার চেষ্টা করলেও কার্যত বাকি বিরোধী দলগুলির ছিল নানা মুনির নানা মত। সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে মমতার সুসম্পর্ক থাকলেও রাহুলের নেতৃত্ব মানতে নারাজ ছিল তৃণমূল। এমনকি, কংগ্রেসকে কার্যত নিয়মিত কড়া ভাষায় আক্রমণ করছিলেন ঘাসফুলের নেতারা। অন্য দিকে ত্রিপুরা, মেঘালয়ে তৃণমূলের প্রার্থী দেওয়া নিয়ে সরাসরিই উষ্মা প্রকাশ করে কংগ্রেস। রাহুল গান্ধী তো মেঘালয়ে গিয়ে সরাসরি আক্রমণও করেন। অরবিন্দ কেজরিওয়াল গোড়া থেকেই কার্যত কংগ্রসের সঙ্গে আলোচনায় উৎসাহ দেখাননি।
সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ মমতার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন। নিজের রাজ্যে আগের বিধানসভা নির্বাচনে রায়বরেলির মতো কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটিতে সৌজন্যের খাতিরে প্রার্থী দেননি। কিন্তু এবার আর তা হবে না বলে আগেই ঘোষণা করে দিয়েছেন। মায়াবতী কার্যত রাজনৈতিক সন্ন্যাসের পথে। তামিলনাড়ুর স্ট্যালিনও ছিলেন উদাসীন। জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমার এনডিএ থেকে বেরনোর পরও বিরোধী শিবিরের সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ রাখেননি। তেলঙ্গানার কেসিআর কিংবা অন্ধ্রের জগনমোহনও কার্যত ছিলেন নির্লিপ্ত। মুখে মাঝেমধ্যে বললেও বল গড়ায়নি।
বরং জোটের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল একাধিক। একদিকে শরদ পাওয়ার, মল্লিকার্জুন খাড়গে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বিরোধী ঐক্যের ব্যাটন নিজের হাতে রাখতে একাধিক দলের নেতাদের সঙ্গে কলকাতায় বৈঠক করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কালীঘাটে বৈঠক করেছেন সপার অখিলেশের সঙ্গে। কর্নাটকে ভোটের কথা মাথায় রেখে মমতার দুয়ারে এসেছেন জেডিএস সুপ্রিমো কুমারস্বামী। আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় নিজে ভুবনেশ্বর গিয়ে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। তাতে বিরোধী জোটে কতটা হাত বাড়িয়েছেন নীতীশ, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও চেষ্টা চলছিল। নীতীশ কুমার নিজের মতো করে তলে তলে যোগাযোগ রাখছিলেন অন্য বিরোধী দলগুলির সঙ্গে। বামেরা অবশ্য গোড়া থেকেই কংগ্রেসের সঙ্গে।
কিন্তু ‘সব চোরেদের পদবী চোর হয় কেন’- রাহুল গান্ধীর এই মন্তব্যের জেরে দু’বছরের সাজা ঘোষণাই যেন এক ধাক্কায় প্রায় সব বিজেপি বিরোধী দলকে একত্রিত করে ফেলেছে। গুজরাত আদালতের রায়ের পরই রাহুলের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দেয় প্রায় সব দল। কংগ্রেস বিরোধী বলে পরিচিত মমতা এবং কেজরিওয়ালও রাহুলের হয়ে ব্যাট ধরেন। বার্তা দেন অখিলেশ থেকে তেজস্বী থেকে নীতীশরা। আর সেই সুযগোকেই কাজে লাগাতে নতুন উদ্যমে ময়দানে নেমে পড়েন মল্লিকার্জুন খাড়গে। মমতা-কেজরিওয়ালের কথা মাথায় রেখে রাহুলকে কার্যত অন্তরালে রেখে সামনের সারিতে কলকাঠি নাড়তে শুরু করেন শরদ পাওয়ার ও মল্লিকার্জুন খাড়গে। অন্য় দিকে মমতাও বার্তা দেন, সব বিরোধীরা এককাট্টা হলে দুহাজার চব্বিশে মোদীর বিজয়রথ উল্টে যাবে।
এই প্রেক্ষাপটেই নতুন স্ট্র্যাটেজি নেন খাড়গে। দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানান জেডিইউ সুপ্রিমোকে। নীতীশও সাড়া দিয়ে দিল্লিতে যান। সোনিয়া-রাহুলের উপস্থিতিতে বৈঠক হয়। কংগ্রেসের অন্দরের খবর, কংগ্রেসকে কার্যত চালিকাশক্তি ব্যাকসিটে রেখে মমতা, কেজরিওয়াল, অখিলেশদের সঙ্গে মধ্যস্থতার দায়িত্ব দেন নীতীশকে। সেই চালে যে কাজ হয়েছে সোমবার নীতীশের নবান্নে আসাই তার প্রমাণ।
সূত্রের খবর, এদিন দুপুর দু’টো নাগাদ নবান্নে বৈঠকে বসবেন মমতা-নীতীশ। দু’জনের মধ্যে অবশ্যই বিরোধী জোট নিয়ে আলোচনা হবে। কীভাবে, কোন পথে সব বিরোধী দলকে এক ছাতার তলায় আনা যায়, তার রণকৌশল এই বৈঠকে স্থির হতে পারে। পাশাপাশি মমতাও কংগ্রেস অ্যালার্জি ঝেড়ে ফেলে ঐক্যের বার্তা দিতে পারেন।
কিন্তু সমস্যা যে নেই এমন নয়। যে রাজ্যে যে আঞ্চলিক দল শক্তিশালী, সেখানে সেই দলের প্রাধান্য দিয়ে আসন ছাড়তে হবে কংগ্রেসকে- এই মতে বিশ্বাসী মমতা। মুখেও সেকথা অনেকবার বলেছেন তৃণমূল নেত্রী। কংগ্রেস সেই শর্ত কতটা মেনে নেবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আবার কংগ্রেস হাই কমান্ড সিদ্ধান্ত নিলেও পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, কর্নাটক, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্বের পক্ষে সেটা কতটা মেনে নেওয়া সম্ভব বা কতটা তাঁরা মেনে নেবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বিরোধীদের প্রায় সব দলের বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। পশ্চিমবঙ্গে যেমন নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে তোলপাড়। অরবিন্দ কেজরিওয়াল আবগারি দুর্নীতিতে হাজিরা দিয়েছেন সিবিআই-এ। তেজস্বী যাদবের বিরুদ্ধে রয়েছে জমির বিনিময়ে চাকরি দুর্নীতির অভিযোগ। একাধিক রাজ্যে কংগ্রেস নেতাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে কমবেশি। খোদ সোনিয়া-রাহুলকে কেন্দ্রীয় এজেন্সির জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
আবার প্রাক ভোট আসন সমঝোতা, নাকি ভোট পরবর্তী জোট, তা নিয়েও মতপার্থক্য রয়েছে। ভোটের আগে জোট কার্যত অসম্ভব। আবার ভোটের পর ফল ভাল না হলে ভেস্তে যাবে সব প্রচেষ্টা। আবার সব দল মিলে সরকার গড়ার পরিস্থিতি তৈরি হলেও নেতৃত্ব বা প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা নিয়ে বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। আবার ভোটের আগে কাউকে প্রধানমন্ত্রী মুখ করে এগোলে বিরোধীদের মধ্যেই ফাটল ধরবেই। মুখে না বললেও সেই জোটে আন্তরিকতা থাকবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
উল্টো দিকে মোদী সরকারের বিরুদ্ধেও গত ৯ বছরে সরকার বিরোধী হাওয়া কিছুটা হলেও জোরদার হয়েছে। এজেন্সি দিয়ে বিরোধীদের হেনস্থার অভিযোগের প্রশ্নে এককাট্টা বিরোধীরা। উগ্র হিন্দুত্বের রাজনীতিতে দেশবাসীর একাংশ তিতিবিরক্ত। আদানি ইস্যুতে খানিকটা হলেও ব্যাকফুটে গেরুয়া শিবির। রাহুলের পদযাত্রায় কংগ্রেসের পালে কিছুটা হাওয়া লেগেছে। ফলে সম্ভাবনা যে এক্কেবারে নেই, এমন নয়। কিন্তু যদিও ২০১৪ সালে ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে এবং মোদীর পক্ষে যে হাওয়া ছিল, চব্বিশের ভোটের আগে তেমন তীব্র গণক্ষোভ দানা বাঁধার মতো পরিস্থিতি নেই। নেই মোদীর বিরুদ্ধে বুক ঠুকে লড়াই করার মতো কোনও মুখ।
সূতরাং, সম্ভাবনা থাকলেও দুর্ভাবনাও অনেক। মোদী বিরোধিতায় এককাট্টা হলেও রয়েছে প্রত্যেক রাজ্যের নিজস্ব রাজনৈতিক সমীকরণ। প্রত্যেক দলের রয়েছে আলাদা অ্যাজেন্ডা। সব মিলিয়ে সম্ভাবনা থাকলেও তাকে কাজে লাগাতে কতটা সফল হবে বিরোধী দলগুলি তার উত্তর মিলবে আরও এক বছর পর।