তৃণমূলের গুন্ডামি, রক্তাক্ত খগেন মুর্মু, মার খেলেন শঙ্কর ঘোষ, ধরা পড়বে নাগরাকাটার দুষ্কৃতীরা?

নাগরাকাটায় আক্রান্ত খগেন মুর্মু ও শঙ্কর ঘোষের উপর জুতো লাঠি নিয়ে হামলা। গাড়িতে রক্তাক্ত খগেন মর্মু (মাঝে)। 
নিজস্ব প্রতিবেদন: গিয়েছিলেন দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে। ত্রাণ নিয়ে। রক্তাক্ত হয়ে ফিরতে হল মালদা উত্তরের সাংসদ খগেন মুর্মুকে। মার খেলেন শিলিগুড়ির বিজেপি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ। যথেচ্ছ ইট-পাথর ছোড়ায় গাড়ির কাচ ভেঙে চুরমার। ধাক্কা, জুতোর ঘা-ও খেয়ে কার্যত প্রাণ নিয়ে ফিরতে হল দুই বিজেপি নেতাকে। দুর্যোগের মধ্যেও এই নিয়ে রাজ্য রাজনীতির জল গড়াল উত্তরবঙ্গের মেঘ ভাঙা বৃষ্টির জলের চেয়েও বেশি গতিতে। খোদ প্রধানমন্ত্রী ঘটনার নিন্দা করেছেন। উল্টোদিকে অপ্রীতিকর ঘটনা কাম্য নয় বলে দায়সারা মন্তব্য করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। 

কিন্তু ঘটনার পর একাধিক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। জনপ্রতিনিধিরাই যদি এভাবে পুলিশের সামনে আক্রান্ত হন, তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? যাঁরা সাংসদকে রক্তাক্ত করলেন, বিধায়ককে মারলেন তাঁদের কি আদৌ গ্রেফতার করবে পুলিশ? এই ঘটনা পরিকল্পিত কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। 

ঠিক কী ঘটেছিল? 

উত্তরবঙ্গ বিজেপির শক্ত ঘাঁটি। শনিবার রাতের ভয়াবহ বিপর্যয়ের পরই বার্তা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। অন্য দিকে মুখ্যমন্ত্রী ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন বলে দাবি করে কার্নিভালে নেচেছেন। দুর্যোগের মধ্যেও কীভাবে কখনও ঢাকের তালে নাচ, কখনও হাস্যকর বেহালা বাজানোর চেষ্টা করেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল বিজেপি। সোমবার অবশ্য উত্তরবঙ্গে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিরোধী শিবিরের একাধিক নেতাও গিয়েছেন উত্তরবঙ্গে। শমীক ভট্টাচার্য সকালেই পৌঁছে যান বাগডোগরায়। শমীকের সঙ্গী হন উত্তরবঙ্গের বিজেপি বিধায়ক, সাংসদরা। একাধিক জায়গায় ঘুরে যান নাগরাকাটার বামনঘাটায়। ছোট নৌকায় এক বারে বেশি মানুষ যাওয়া সম্ভব নয় বলে ধাপে ধাপে এলাকায় পৌঁছন শমীক ভট্টাচার্য, খগেন মুর্মু, শঙ্কর ঘোষ, দীপক বর্মনরা। সেখান থেকে ফেরার সময়ও ধাপে ধাপে ফিরছিলেন। শমীক এবং দীপক বর্মন আগে ফিরে আসেন। তার পরই শুরু হয় গুন্ডামি। এলাকায় তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিতরা হামলা, আক্রমণ শুরু করে। খগেন ও শঙ্করকে উদ্দেশ্য করে প্রথমে স্লোগান। তার পর ধাক্কাধাক্কি। জুতো দিয়েও মারতে দেখা যায়। নিরাপত্তারক্ষীরা কোনওরকমে তাঁদের গার্ড করে গাড়িতে তোলেন। এর পরই শুরু হয় বেপরোয়া হামলা। বাঁশ লাঠি দিয়ে গাড়িতে চলতে থাকে আঘাত। শঙ্কর ঘোষকে কাঠের বাটাম দিয়ে আঘাত করতে উদ্যত হয় একজন। তার মধ্যে শঙ্কর গাড়িতে উঠে পড়েন বলে কোনওক্রমে রক্ষা পান। এর পর গাড়িতে পাথর ছোড়া শুরু হয়। উড়ে আসতে থাকে বড় বড় পাথর। গাড়ির কাচ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। একাধিক পাথর লাগে খগেন মুর্মুর গায়ে। তাঁর চোখের নীচে আঘাতে গলগল করে রক্ত ঝরতে থাকে। 

রক্তে ভেসে যাচ্ছে পাঞ্জাবী। উত্তরীয়, রুমাল দিয়ে মুছেও আটকানো যাচ্ছে না রক্ত। গাড়ির ভিতরের একটি ভিডিওতে সেই ছবি দেখে শিউরে উঠেছে রাজ্যবাসী। পরে খগেন মুর্মু, শঙ্কর ঘোষকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর শিলিগুড়ির একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দু’জন। 

তোলপাড় দিল্লি

ঘটনার পরই তোলপাড় বঙ্গ রাজনীতি। জল গড়িয়েছে দিল্লিতেও। খোদ প্রধানমন্ত্রী এক্স হ্যান্ডলে ঘটনার নিন্দা করে লিখেছেন,  ‘‘যে ভাবে আমাদের দলের সহকর্মীরা—যাঁদের মধ্যে একজন বর্তমান সাংসদ ও বিধায়কও রয়েছেন—পশ্চিমবঙ্গে বন্যা ও ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সেবা করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এটি তৃণমূল কংগ্রেসের অসংবেদনশীলতা এবং রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার করুণ রূপের স্পষ্ট প্রতিফলন। ’’ শমীক ভট্টাচার্যকে ফোন করে ঘটনার খবর নিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। পরে শমীক ভট্টাচার্য নিজের এক্স হ্যান্ডলে সেকথা জানিয়েছেন। তৃণমূলের পরিকল্পিত হামলা বলে মন্তব্য বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর। 

পরিকল্পিত হামলা?

শমীক ভট্টাচার্য, দীপক বর্মনরা বামনহাটা থেকে ফেরার পরই হামলার ঘটনা ঘটে। ফলে পরিকল্পিত হামলার তত্ত্ব উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া খগেন এবং শঙ্কর দু’জনই সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া নেতা। সেদিক থেকেও হামলা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। শুভেন্দু অধিকারী স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুন্ডারা পরিকল্পিত ভাবে বিজেপি সাংসদ ও বিধায়কের উপর হামলা চালিয়েছে।’’ বিজেপির ফালাকাটার বিধায়ক দীপক বর্মন বলেন, ‘‘আমরা এলাকায় পৌঁছোনোর পর কোনও অজানা কারণে ঘটনাস্থল ছেড়ে ডিআইজি এবং এসপি চলে গিয়েছিলেন। তার পরেই হামলা হয়। ফলে হামলা পরিকল্পিতই ছিল। নাগরাকাটা থানায় আমরা অভিযোগ দায়ের করব।’’ দীপকের আরও অভিযোগ, পুলিশের সামনেই গোটা ঘটনা ঘটেছে। পুলিশেরই স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে অভিযোগ দায়ের করা উচিত ছিল। কিন্তু পুলিশ সেটা করেনি বলেই দাবি পদ্ম-বিধায়কের।

কী বলছে তৃণমূল?

কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সে সবে পাত্তা দিতে নারাজ। সামান্য ঘটনার মতোই তাঁর মনোভাব। উত্তরবঙ্গ সফরেই রয়েছেন তিনি। ঘটনার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে চেনা ছকের বুলি আওড়েছেন, একতা ও ধৈর্যই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। এই সময় কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা কাম্য নয়।’ যেন কিছুই হয়নি, এমন একটা মনোভাব। আর তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের বক্তব্য, এত গাড়ির বহর নিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি, গাড়িতে ত্রাণ ছিল না, ফোটো সেশন করতে গিয়েছিলেন, সাধারণ মানুষের ক্ষোভের প্রতিফলন, এমন কিছু কথা। অর্থাৎ জনরোষের তত্ত্ব। শেষে চাঁদ সওদাগরের বাম হাতে পুজো দেওয়ার মতো বক্তব্য, যে ভাবে হামলা হয়েছে, তা দল সমর্থন করে না। মুখ্যমন্ত্রী হোক বা তাঁর দল, একবারও কেউ বলেননি, অপরাধীদের পুলিশ গ্রেফতার করবে বা গ্রেফতার করতে হবে। বরং কৌশলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে দিয়েছেন, ‘একতা’ ও ‘ধৈর্য’র কথা। সূতরাং বার্তা স্পষ্ট। কারা হামলা চালিয়েছে, সেটা বুঝে ব্যবস্থা নেবেন। 

গুন্ডারা গ্রেফতার হবে? 

যখন মুখ্যমন্ত্রী বলেননি, তখন এই গুন্ডা, দুষ্কৃতীদের কেউ গ্রেফতার করবে, এমন পুলিশ অফিসার এ রাজ্যে কেউ আছে? কার ধরে ক’টা মাথা? রাতের  দিকের খবর, একটি এফআইআর দায়ের হয়েছে অজ্ঞাত পরিচয়দের বিরুদ্ধে। অথচ ভিডিও-তে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে, কারা হামলা চালিয়েছে। চ্যানেলে চ্যানেলে বিজেপি নেতারা তাঁদের ছবি ধরে ধরে নাম বলে দিয়েছেন। তার পরও পুলিশ অজ্ঞাতপরিচয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তৃণমূল জনরোষের তত্ত্ব আওড়েছে। তাও যদি হয়, নতুন ভারতীয় ন্যয় সংহিতায় তারও নির্দিষ্ট বিধান আছে। সেই আইনে কেন গ্রেফতার করা হবে না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আর পুলিশের এই গা ছাড়া মনোভাব কি আসলে দুষ্কৃতীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া? আবার পরে যদি গ্রেফতারও হয়, তাহলেও লঘু ধারায় মামলা হবে। জামিন পেয়ে দিব্যি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবেন। 

ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে!

কিন্তু পরিস্থিতি তো একদিন না একদিন পাল্টাবেই। ছাব্বিশে কী হবে, সেটা এখনই ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। কিন্তু একটা সময় নিশ্চয়ই আসবে, যখন তৃণমূল বিরোধী আসনে থাকবে। তখন এই ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া যে হবে না, তার নিশ্চয়তা কিন্তু নেই। আর এই তৃণমূলও এক সময় বিরোধী ছিল। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে একাধিকবার আক্রান্ত হয়েছেন। ৯৩-এর আন্দোলনে মার খাওয়ার কথা, লালু আলমের লাঠির কথা এখনও নিজে বলেন। বাম জমানার অত্যাচারের কথা ক্ষমতায় আসার ১৪ বছর পরও বলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু নিজের দলের স্যাঙাতরা এমন নৃশংস হামলার পরও তাঁর মুখে কোনও কড়া বার্তা নেই। এমমকি নিন্দাও নেই। শেষ পরিণতি কী হয়, তার জন্য হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে।