কাজির বিচার? নাকি পাপের শাস্তি? মহুয়ার বহিষ্কার এবং কিছু প্রশ্ন?

ঘুষের বিনিময়ে প্রশ্ন (Cash for Query) কাণ্ডে লোকসভা থেকে বহিষ্কৃত তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র (Mahua Moitra)। 
নিজস্ব প্রতিবেদন: ঘুষের বিনিময়ে প্রশ্ন (Cash for Query) কাণ্ডে লোকসভা (Lok Sabha) থেকে শেষ পর্যন্ত বহিষ্কারই হলেন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র (Mahua Moitra)। প্রেক্ষাপট তৈরিই ছিল। শুধু কয়েকদিন পিছিয়ে গেল। মহুয়ার বহিষ্কারে অবশেষে শুক্রবার সিলমোহর পড়ল সংসদের। বহিষ্কারের পরই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত বিরোধীরা। 

 ১৯৭৪ সালের লোকসভা ভোটে রায়বরেলি কেন্দ্রে প্রচারে সরকারি আধিকারিকদের ব্যবহারের অভিযোগে ইন্দিরা গান্ধীকে লোকসভা থেকে বহিষ্কার করেছিল মোরারজি দেশাই সরকার। ইন্দিরা গান্ধীর বহিষ্কার প্রসঙ্গে একটি প্রতিবেদনে সেই সময় নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, ট্রাফিক আইন ভাঙার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড। মহুয়ার ক্ষেত্রেও কি সেটাই হল? কেউ কেউ বলছেন ‘কাজির বিচার’। মহুয়া নিজেও বলেছেন ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’। যে ধরনের বিস্ফোরক অভিযোগ, তাতে যে মহুয়াকে বহিষ্কার করা যায় না, এমন কথা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না সংসদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের বড় অংশই। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে বহিষ্কারের পদ্ধতি এবং তাড়াহুড়ো নিয়ে। শুক্রবার সংসদের অভ্যন্তরেও এই প্রশ্নেই সরব ছিলেন বিরোধী সাংসদরা। উঠে আসছে একাধিক প্রশ্ন। তা নিয়ে চাপানউতোরও চরমে। 

ঘুষের প্রমাণ কোথায়? 

মহুয়ার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, ঘুষের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন করা। অভিযোগ, শিল্পপতি দর্শন হিরানন্দানির কাছ থেকে টাকা এবং উপহার নিয়েছেন মহুয়া। মুশকিল হল, উপহার যে ঘুষ, তা প্রমাণ করা কার্যত অসম্ভব। অন্য দিকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণ দূরে থাক, তদন্তই হয়নি। এথিক্স কমিটি সুপারিশ করেছে, টাকা নিয়েছেন কিনা, কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা তা তদন্ত করে দেখুক। সেই তদন্ত শুরুই হয়নি। অর্থাৎ ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণের জন্য তদন্তই শুরু হয়নি, তার আগেই শাস্তি হয়ে গেল। অনেকেই বলছেন, এই প্রমাণ হওয়া পর্যন্ত কি অপেক্ষা করা যেত না? 

আলোচনায় কম সময়

সংসদে আলোচনার জন্য যে সময় দেওয়া হয়েছিল, তা পর্যাপ্ত নয়। বিরোধীদের অভিযোগ, ৪৪৫ পাতার রিপোর্ট মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে কীভাবে পড়া সম্ভব? এই প্রশ্নেই কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী যেমন ২-৩ দিন সময় চান আলোচনার জন্য। কিন্তু ট্রেজারি বেঞ্চের দাবি, সংসদের এই সংক্রান্ত আইন মেনেই সব কিছু হয়েছে। পাশাপাশি ২০০৫ সালে ১১ সাংসদের বহিষ্কারের নজির তুলেও পাল্টা আক্রমণ শানিয়েছেন বিজেপি সাংসদ-নেতারা। 

আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ 

মহুয়ার ক্ষেত্রে Natural Justice বা স্বাভাবিক ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়েছে - এই প্রশ্নও তোলা হয়েছে বিরোধী বেঞ্চ থেকে। আইনের ভাষায় বলা হয়, অনেক দোষীকেও মুক্তি দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু এক জন নির্দোষও যেন শাস্তি না পায়। যাঁকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, তাঁর বক্তব্য না শুনে বিধান ঘোষণা করা কার্যত কাজির বিচারের সমান। মহুয়ার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে বলে লোকসভায় সরব হন তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও শাসক পক্ষের যুক্তি, এথিক্স কমিটিতে মহুয়াকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি কমিটির সামনে দীর্ঘ বক্তৃতাও দেন। কিন্তু মাঝপথে জিজ্ঞাসাবাদ ছেড়ে বেরিয়ে ‘নাটক’ করেন। যদিও শাসক শিবিরের দাবি, ঘুষের বিনিময়ে প্রশ্নের অভিযোগ সংক্রান্ত প্রসঙ্গ ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়নি মহুয়াকে। মহিলা ভিকটিম কার্ডও খেলেন। অর্থাত্‍ একজন মহিলার সম্ভ্রম নিয়ে আপত্তিকর প্রশ্ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। 

হিরানন্দানির সাক্ষ্য 

এথিক্স কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে দর্শন হিরানন্দানির হলফনামার কথা। অর্থাত্‍ শিল্পপতি হিরানন্দানি দুবাই থেকে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সামনে যে হলফনামা দিয়েছেন, তাতে তিনি বিদেশ থেকে লগ ইন করার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। প্রশ্ন করার বিনিময়ে ঘুষ বা উপঢৌকনের কথাও স্বীকার করে নিয়েছেন ওই হলফনামায়। কিন্তু বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, হিরানন্দানিকে কেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বা কথা বলার জন্য ডাকা হল না। ওই হলফনামা চাপ দিয়ে লেখানো হয়েছে কিনা, নাকি তিনি স্বেচ্ছায় লিখেছেন, সে সব বিষয়ে কোনও কিছু না জেনেই শাস্তি ঘোষণা করে দেওয়া হল। পদ্ম শিবিরের পাল্টা যুক্তি, মহুয়া নিজেও সংসদের লগ ইন আইডি পাসওয়ার্ড শেয়ার করার কথা মেনে নিয়েছেন। বিদেশ থেকে লগ ইনের প্রমাণও হাতেনাতে রয়েছে। ফলে এই যুক্তি ধোপে টেকে না। 

যুদ্ধকালীন তৎপরতা 

বিরোধী সাংসদ বলেই কি এত তাড়াহুড়ো করে সাংসদ পদ খারিজ করা হল? স্বাধিকার ভঙ্গের প্রশ্নই যদি হয়, তাহলে এর আগেও বহু সাংসদের বিরুদ্ধে এমন নজির রয়েছে। আগের অধিবেশনেই বিএসপির সাংসদ দানিশ আলিকে কুরুচিকর ভাষায় আক্রমণ করেন বিজেপি সাংসদ রমেশ বিদুরি। তাঁর বিরুদ্ধে এখনও কোনও পদক্ষেপই করা হয়নি। আবার ২০১১ সালের উদাহরণ দিচ্ছে শাসক শিবির। সেই সময় ১১ জনের মধ্যে ছজন বিজেপির, বিএসপির তিন জন, আরজেডির এক জন এবং কংগ্রেসের এক জন সাসংদ ছিলেন। অর্থাত্‍ শুধু বিরোধী নয়, শাসক দলের সাংসদও ছিলেন। অথচ এক্ষেত্রে মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে তড়িঘড়ি ব্য়বস্থা নেওয়া হল। রমেশ বিদুরির কিছুই হল না। 

আদানি ইস্যু

মহুয়া বাগ্মী সাংসদ। সংসদে আদানির বিরুদ্ধে সুর চড়িয়ে যিনি সবচেয়ে বেশি সরব, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মহুয়া। তৃণমূল শিবিরের দাবি, আদানিদের বিরুদ্ধে সরব বলেই মহুয়ার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে শাসক দল। মোদী-আদানি যোগসাজশের অভিযোগ ধামাচাপা দিতেই এমন সিদ্ধান্ত। 

জাতীয় সুরক্ষা

সংসদের পোর্টালের লগ-ইন আইডি পাসওয়ার্ড শেয়ার করে জাতীয় সুরক্ষার সঙ্গে আপোস করেছেন মহুয়া মৈত্র, এমন অভিযোগ গোড়া থেকেই তুলে আসছে গেরুয়া শিবির। শুধু তাই নয়, সংসদের অবমাননা করেছেন, যাতে শুধু মহুয়া বা তাঁর দলের নয়, সব সাংসদেরই মর্যাদা হানি করা হয়েছে। অমর্যাদা করা হয়েছে সংসদের গরিমাকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই লগ ইন আইডি পাসওয়ার্ড বিষয়টিই নতুন। এ সম্পর্কে সংসদে সুষ্পষ্ট কোনও আইন নেই। শুধু সাংসদদের একটি হলফনামা দিতে হয় যে এই আইডি-পাসওয়ার্ড কাউকে শেয়ার করবেন না। অথচ অনেক সাংসদই তাঁদের পিএ বা অফিসের কর্মীদের দিয়ে প্রশ্ন টাইপ করানোর মতো কাজ করে থাকেন। কিন্তু মহুয়ার বিপক্ষে গিয়েছে বিদেশ থেকে লগ ইন এবং একজন শিল্পপতিকে শেয়ার করা।