ধাক্কা খেয়েও শিক্ষা নেই! কেন চিহ্নিত দাগিদের পাশে বারবার দাঁড়াচ্ছে রাজ্য, এসএসসি?

চিহ্নিত দাগিদের পাশে দাঁড়ানোর অধিকার কি আপনাদের আছে? এসএসসি-কে (SSC) প্রশ্ন কলকাতা হাইকোর্টের (Calcutta High Court) বিচারপতি সৌমেন সেনের।  
নিজস্ব প্রতিবেদন: কলকাতা হাইকোর্টের (calcutta high court) সিঙ্গল বেঞ্চে ধাক্কা খেয়েও শিক্ষা নেই। চিহ্নিত অযোগ্যদের নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ঢোকাতে মরিয়া স্কুল সার্ভিস কমিশন (school service commission) এবং রাজ্য সরকার এবার ডিভিশন বেঞ্চে। কিন্তু সেখানেও বিচারপতির একগুচ্ছ প্রশ্নের মুখে এসএসসি এবং রাজ্য। চিহ্নিত অযোগ্যদের পক্ষে সওয়াল করার মতো জায়গায় কি আছে এসএসসি? এই প্রশ্ন তুলেছে বিচারপতি সৌমেন সেনের ডিভিশন বেঞ্চ। শীর্ষ আদালতের রায়ে দুর্নীতির জন্য চাকরি খুইয়েছেন, অথচ সেই চিহ্নিত অযোগ্যদের জন্যই কমিশনের কেন এত দরদ, কার্যত সেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে হাইকোর্ট। 
কলকাতা হাইকোর্টে প্রথমে সিঙ্গল বেঞ্চ এবং তার পর ডিভিশন বেঞ্চ ২০১৬ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ করা শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীদের পুরো প্যানেল বাতিল করে  দেয়। চাকরি খোয়ান প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মী। হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের যুক্তি ছিল, চাল এবং কাঁকড় আলাদা করা যায়নি। অর্থাৎ যোগ্য এবং অযোগ্যদের আলাদা করা যায়নি। যার অর্থ, যাঁদের অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়নি, তাঁদের মধ্যেও সবাই যোগ্য, এমন কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ সিবিআই তদন্ত করে যাঁদের অযোগ্য বা দাগি হিসেবে চিহ্নিত করে, রাজ্য বা এসএসসি নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি, সেটাই চূড়ান্ত এবং তার বাইরে আর কোনও অযোগ্য প্রার্থী নেই। হাইকোর্ট স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়, সাদা ওএমআর জমা দিয়ে,  প্যানেল উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর নিয়োগ-সহ ১৭ রকমের দুর্নীতি হয়েছিল। 

কী ছিল সুপ্রিম কোর্টের রায়? 

হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য। গত ৩ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টও সেই রায়ে হস্তক্ষেপ করেনি, অর্থাৎ হাইকোর্টের রায়ই বহাল রাখে। তবে কিছু মডিফিকেশন করে। জানিয়ে দেওয়া হয়, চিহ্নিত অযোগ্যদের বেতন ফেরত দিতে হবে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্য়ে নতুন করে নিয়োগের কথাও বলে সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৬ সালের নিয়ম মেনে নিয়োগ করার নির্দেশও দেয় শীর্ষ আদালত। 

ডিভিশন বেঞ্চেও প্রশ্নের মুখে রাজ্য

স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারির পরই যত গোল বাধে। মামলা দায়ের হয় কলকাতা হাইকোর্টে। এই মামলাতেই প্রথমে সিঙ্গল বেঞ্চে কার্যত মুখ পোড়ে রাজ্য সরকারের।  অযোগ্যদের ছাড়াই নিয়োগ করতে হবে বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের বিচারপতি সৌগত ভট্টাচার্য। সেই নির্দেশকেই চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ রাজ্য এবং এসএসসি। সিঙ্গল বেঞ্চেও এক গুচ্ছ প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় স্কুল সার্ভিস কমিশনকে। এবার ডিভিশন বেঞ্চেও বিচারপতি সৌমেন সেনের প্রশ্নবিদ্ধ রাজ্য ও এসএসসি। বিচারপতি সেনের প্রশ্ন, “চিহ্নিত অযোগ্যদের নিয়ে সওয়াল করার মতো জায়গায় কি কমিশন আছে? চিহ্নিত অযোগ্যদের নিয়োগে অংশ নেওয়া বা না নেওয়া নিয়ে কমিশন কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে?”

ফের অযোগ্যদের পাশে এসএসসি

স্কুল সার্ভিস কমিশনের আইনজীবী ছিলেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সিঙ্গেল বেঞ্চের মতোই ডিভিশন বেঞ্চেও চিহ্নিত অযোগ্যদের পাশে দাঁড়ায় স্কুল সার্ভিস কমিশন। কল্যাণের সওয়াল, “চিহ্নিত অযোগ্যরাও অংশ নিতে পারবে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অযোগ্যদের পরীক্ষায় বসতে কোনও বাধা নেই। চিহ্নিত অযোগ্যরা নিয়োগে অংশ নিতে না পারলে, অসফল প্রার্থীরাও পারবেন না।” তৃণমূল সাংসদ তথা আইনজীবী কল্যাণের আরও যুক্তি “কেউ কোনও একটা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন, সেখানে অসফল হয়েছেন। তাঁরা ভবিষ্যতে কোনও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন না ?” সিঙ্গল বেঞ্চেও একই যুক্তি দেখিয়েছিলেন কল্যাণ। আইনজীবী মহলের মতে, ২০১৬ সালের অসফল প্রার্থীদেরও চিহ্নিত অযোগ্যদের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে কার্যত পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটাকেই গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এতে সমস্যা বাড়ছে যোগ্যদেরও। তবে কল্যাণের যুক্তিতে চিঁড়ে ভেজেনি। সিঙ্গল বেঞ্চের বিচারপতির রায়েই তা স্পষ্ট। 

বিচারপতি সৌমেন সেনের প্রশ্ন

ডিভিশন বেঞ্চেও বিচারপতি সৌমেন সেনের প্রশ্ন, সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী যাঁরা দুর্নীতি করেছেন, প্রতারণার জন্য যাঁদের চাকরি বাতিল করা হয়েছে তাঁরাও এই নিয়োগে অংশ নিতে পারবেন ?  কিন্তু যেভাবে চিহ্নিত দাগিদের হয়ে ব্যাট চালিয়ে যাচ্ছেন কল্যাণ, তাতে অনেকেই মনে করছেন, ডিভিশন বেঞ্চের রায়ও যদি সিঙ্গল বেঞ্চের মতোই হয়, তাহলে সুপ্রিম কোর্টেও যেতে পারে স্কুল সার্ভিস কমিশন। কিন্তু এই সিঙ্গল এবং ডিভিশন বেঞ্চে কমিশনের এই সওয়ালের পর উঠে আসছে একাধিক প্রশ্ন। 

কেন দাগিদের পাশে রাজ্য? 

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি গিয়েছে। তাঁরা যে দুর্নীতি করে চাকরি করেছেন, সেটা স্পষ্ট। তার পরও এদের পাশে দাঁড়াচ্ছে কমিশন এবং পরোক্ষে রাজ্য। শুধু এখন নয়, মামলার গোড়া থেকেই। আইনজীবী মহলের একাংশ মনে করেন, গোড়াতেই যদি রাজ্য সরকার বা এসএসসি বলে দিত যে এর বাইরে আর কোনও অযোগ্য বা দাগি নেই, তা হলে তার জন্য যোগ্যদের চাকরি যেত না। কিন্তু সেই কাজ রাজ্য করেনি, ফলে জটিলতা বাড়তে বাড়তে শেষ পর্যন্ত সবার চাকরি গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অযোগ্যদের পাশে দাঁড়ানোর কারণ খুঁজতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকেই একাধিক বিষয় সামনে আনছেন। তাঁদের বক্তব্য, দাগিদের সব আশা শেষ হয়ে গেলে তাঁরা মরিয়া হয়ে উঠতে পারেন। যাঁদের কাছে টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের উপর চাপ তৈরি করতে পারেন। ফলে জড়িয়ে যেতে পারেন তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের অনেকেই। তাতে শাসক দলের ভাবমূর্তি খারাপ হতে পারে। সেই কারণেই অযোগ্যদের জন্য শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে চাইছে এসএসসি এবং পরোক্ষে রাজ্য। 

নিয়োগের ভবিষ্যৎ কী? 

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও অনেক প্রশ্ন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল, ২০১৬ সালের নিয়োগের নিয়ম মেনে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু স্কুল সার্ভিস কমিশনের বিজ্ঞপ্তি সামনে আসতেই দেখা যায়, কার্যত ২০১৬ সালের নিয়োগের নিয়ম অনেক ক্ষেত্রেই মানা হয়নি। যেমন শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য বরাদ্দ নম্বর পাল্টে গিয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত নন, এমন চাকরিহারাদের বড় অংশ। আবার ২০১৬ সালের বাতিল হওয়া ২৬ হাজার শূন্য পদে শুধু নয়, তার সঙ্গে বর্তমানের শূন্যপদ মিলিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। তাতে বিষয়টি কার্যত গুলিয়ে গিয়েছে। অযোগ্য চিহ্নিত নন, এমন প্রার্থীরা প্রশ্ন তুলছেন, এটা কার্যত পিছনের দরজা দিয়ে চিহ্নিত দাগিদের সুযোগ করে দেওয়া। তাঁদের স্পষ্ট দাবি, ২০১৬ সালে যে ২৬ হাজার শূন্যপদ ছিল, শুধুমাত্র সেই পদেই নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে এবং তাতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন শুধুমাত্র ২০১৬-তে অংশগ্রহণ করা প্রার্থীরাই। তবে অবশ্যই চিহ্নিত দাগিরা নয়। আর বর্তমানের শূন্যপদে নিয়োগ করতে হলে আলাদা বিজ্ঞপ্তি জারি করা হোক। এই নিয়ে আইনি লড়াই চলছে। যা পরিস্থিতি তাতে সব জটিলতা ও আইনি জট কাটিয়ে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্য়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা যাবে কিনা, তা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে। কারণ এই লড়াই শীর্ষ আদালত পর্যন্তও যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত কী পরিস্থিতি দাঁড়ায়, তার দিকে নজর থাকবে পর্যবেক্ষকদের।