নভেম্বর বিপ্লব! পাখির চোখ পঞ্চায়েত, বাম-ডান সবাই ছুটছে গ্রামে

পঞ্চায়েত ভোটের আগে বাম-ডান সবার নজর গ্রামে জনসংযোগ। - অলঙ্করণ: সুবর্ণরেখা টিম

নিজস্ব প্রতিবেদন: বছর ঘুরলেই রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট (Panchayat Election 2023) । গ্রামের ভোট। গ্রাম বাংলা দখলের লড়াই। তাই সব রাজনৈতিক দলের পাখির চোখ গ্রাম। রাজনৈতিক দলগুলির কর্মসূচি মনে করিয়ে দিচ্ছে নকশাল আন্দোলনের সেই স্লোগান, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো। 

পুলিসের গুলিতে দুই শিশু-সহ এগারো জনের মৃত্যু। শিলিগুড়ির অদূরে নকশালবাড়ির একটি গ্রাম। জোতদার, জমিদার, পুলিসের দমন-পীড়ন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমছিল দীর্ঘদিন ধরেই। এই ঘটনা যেন বারুদে অগ্নিসংযোগের কাজ করল। শুরু হল এক সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন। চারু মজুমদার, কানু সান্যালদের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবে যোগ দিলেন হাজার হাজার যুবক, যুবতী। সরকারি শাসনযন্ত্রের ভিত নড়িয়ে দেওয়া সেই আন্দোলন সফল না হলেও স্বাধীন ভারত তথা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটা টার্নিং পয়েন্ট। ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উত্স’ ছাড়াও ওই আন্দোলনের অন্যতম স্লোগান ছিল ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো’। 

তৃণমূলের ‘চলো গ্রামে যাই’

রাজ্যে মোট গ্রামের সংখ্যা প্রায় ৪১ হাজার। মোট পঞ্চায়েত ৩৩৩৯টি। একইসঙ্গে পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদ অর্থাৎ ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ভোট আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলে। তার আগে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের (TMC) স্লোগান, চলো গ্রামে যাই। কর্মসূচির মোদ্দা বিষয়বস্তু হল, গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে যাবেন তৃণমূলের মহিলা শাখার নেত্রীরা। খোঁজ খবর নেবেন। শুরু হয়েছে দুয়ারে সরকার ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে কী কী সুবিধা পাবেন, কারও কোনও সমস্যা থাকলে সেগুলি শোনা এবং সমাধানের চেষ্টা করা। সরকারি সুযোগ সুবিধা কী পেয়েছেন, কী পাননি সেই সব বিষয়েও জানবেন মহিলা নেত্রীরা। 

রাজনৈতিক শিক্ষানবীশেরও বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই কর্মসূচি আসলে জনসংযোগ বাড়ানো। আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলে পঞ্চায়েত ভোট করানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। হাতে আর মাস পাঁচেক সময়। আগেভাগেই ময়দানে নেমে পড়ছে শাসক দল। ভোটের আগে এক্কেবারে হেঁশেলে ঢুকে পড়তে চাইছে ঘাসফুল। হাঁড়ির খবর নিয়ে সেই অনুযায়ী ভোটের ব্লু প্রিন্ট সাজাবে শাসক দল। 

সিপিএমের (CPM) নেতৃত্বে রাজ্যে ৩৪ বছর বাম শাসন ছিল। তার অবসান ঘটিয়ে ২০১১-সালে রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে বহু প্রকল্প ঘোষণা হয়েছে। স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, সবুজ সাথী, শ্মশান বন্ধুর মতো প্রকল্প রাজ্যের গ্রামাঞ্চলের ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখেই। গ্রামাঞ্চলের একটা বিরাট অংশের মানুষ এই সব প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলেন, দল-মত নির্বিশেষে প্রতিটি গ্রামের প্রায় প্রত্যেকের ঘরে সরকারের কোনও কোনও প্রকল্পের সুবিধা ঢুকেছে। শহরের মানুষও পেয়েছেন সুবিধা। ফলে ২০১১ সালের পর সময় যত গড়িয়েছে, তৃণমূলের গ্রামীণ ভোটব্যাঙ্ক শক্তিশালী হয়েছে। 

প্রশ্ন হল, শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ভোটব্যাঙ্ক থাকতেও কেন তাহলে আবার গ্রামে ফেরা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একটা বড় অংশের ব্যাখ্যা, ভোটব্যাঙ্ক থাকলেও শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি থেকে গরু-কয়লা পাচার, একের পর এক নেতা-মন্ত্রী গ্রেফতার, বিপুল অঙ্কের টাকা উদ্ধারে অস্বস্তি বেড়েছে রাজ্যের শাসক দলের। গ্রামীণ ভোটব্যাঙ্কেও যে তার প্রভাব পড়বে না, একথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। গ্রামেগঞ্জে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে দুর্নীতির আলোচনা। বাজারের চায়ের দোকানে, সেলুনে, ক্লাবে যুবকদের আলোচনায়, এমনকি, মহিলাদের আড্ডাতেও উঠে আসছে দুর্নীতি নিয়ে নানা মন্তব্য, আলোচনা, চর্চা। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব নিশ্চিন্তে ঘুমানোর মতো অবস্থায় নেই। 

আরও পড়ুন: বছর ঘুরলেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। ভোটে ছাপ ফেলবে এই পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি?

শেষ বিধানসভা ভোটে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথীর মতো প্রকল্প ভোটে ব্যাপক ডিভিডেন্ট দিয়েছে তৃণমূলকে। গ্রাম বাংলার মহিলারা বিশেষ করে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে ব্যাপক আকৃষ্ট হয়েছেন। দুয়ারে সরকারের ক্যাম্পের ভিড় দেখেই তার প্রমাণ মিলেছে। মহিলারাও দু’হাত উজার করে ভোট দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রীকে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, একুশের ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ের নেপথ্যে অন্যতম অনুঘটক ছিল মহিলা ভোট। স্বাস্থ্যসাথীর মতো প্রকল্প মমতাকে বিরাট ডিভিডেন্ড দিয়েছে। গ্রাম বাংলার মহিলারা দু’হাত উপুর করে ভোটবাক্সে আশীর্বাদ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাই আবার সেই মহিলা ভোটকেই টার্গেট করেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার কর্মসূচিতেও সামনের সারিতে এগিয়ে দিয়েছেন মহিলাদের। তাতে মহিলাদের মন বোঝা যেমন সহজ হবে, তেমনই একেবারে হেঁশেল পর্যন্ত পৌঁছে যেতেও কোনও অসুবিধা হবে না নেত্রীদের।  

বামেদের ‘গ্রাম জাগাও বাংলা বাঁচাও’

অথচ প্রায় তিন দশক ধরে একেকটা গ্রাম ছিল কার্যত এক একটা লাল দুর্গ। তার উপর ভর করেই ৩৪ বছর কার্যত একছত্র আধিপত্য ছিল বামেদের। কিন্তু ২০১১ সালে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হতে হতে এখন কার্যত রক্তশূন্য। তবে ধীরে ধীরে আবার কিছুটা হলেও বামে ফেরার ইঙ্গিত মিলতে শুরু করেছে। কলকাতা পুরসভার উপনির্বাচনে বিজেপিকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা, ১০৮ পুরসভার ভোটে বেশ কিছু পুরসভাতেও একইভাবে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা এবং তাহেরপুর পুরসভা দখলে তার ইঙ্গিত মিলেছে। আমতায় আনিসকাণ্ডে মিছিল, মুর্শিদাবাদের একাধিক জায়গায় ডিওয়াইএফআই-এর কর্মসূচিতে ব্যাপক সাড়া এবং কলকাতার একাধিক মিছিলে জমায়েতেও সেই ইঙ্গিত মিলেছে। বাম জমানার একাধিপত্য ফিরবে না, এটা ঠিক, কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি নেই বামেদের। সেই লক্ষ্যেই তাঁদের কর্মসূচি ‘গ্রাম জাগাও বাংলা বাঁচাও’। 

আরও পড়ুন: ৭ নভেম্বরের পর চাকরিটা থাকবে তো! আতঙ্কে ঘুম উড়েছে ঘুষের শিক্ষকদের

ইতিমধ্যেই সেই কর্মসূচির রূপরেখাও তৈরি হয়েছে। আলিমুদ্দিন সূত্রে খবর, নভেম্বর মাসব্যাপী গ্রামে গ্রামে এই পদযাত্রা হবে। ‘পঞ্চায়েতে কত পেলে, কত খেলে? হিসাব চাই, হিসাব দাও’, ‘লুটেরাদের উচ্ছেদ কর, মানুষের পঞ্চায়েত গড়ো’ - গ্রামের অলিগলিতে শোনা যাবে এমন সব স্লোগান।  রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগকে হাতিয়ার করে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে, দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ পঞ্চায়েত গঠনের। বিধানসভা, লোকসভায় শূন্য হয়ে গিয়েছে লাল পার্টি। শিবরাত্রির সলতে তাহেরপুর পুরসভা। এই পরিস্থিতিতে লাল ঝান্ডা গ্রাম বাংলাকে কতটা জাগাতে পারে আগামী পঞ্চায়েত ভোটে তারই পরীক্ষা বিমান বসু, মহম্মদ সেলিমদের।

ঘর গোছাচ্ছে পদ্ম শিবিরও

বসে নেই বিজেপিও (BJP) । তবে তৃণমূল সিপিএমের চেয়ে কিছুটা হলেও পিছিয়ে। কিছুটা ধীরে চলো নীতিতে ‘গ্রামে চলো’ কর্মসূচি নিয়েছে বিজেপি। নভেম্বরের গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত এক মাসব্য়াপী বাড়ি বাড়ি যাওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা হলেও ময়দানে পদ্মের ছাপ পড়েনি। অক্টোবরের মাঝামাঝি কলকাতায় এসে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রস্তুতি বৈঠক সেরে গিয়েছেন এ রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা সুনীল বনসল। ওই বৈঠকে পৎ্চায়েত ভোট নিয়ে আলোচনা হলেও স্পষ্ট কোনও ব্লু প্রিন্ট প্রকাশ্যে আসেনি। তবে পদ্ম শিবির সূত্রে খবর, দলের মূল হাতিয়ার হবে তৃণমূলের দুর্নীতি। কোন পঞ্চায়েতে কোন খাতে কত টাকার এবং কীভাবে দুর্নীতি তৈরি হয়েছে বুথে বুথে তার তালিকার খসড়া তৈরির নির্দেশ গিয়েছে নীচুতলায়। সেই অনুযায়ী জেলা, ব্লক, পঞ্চায়েত ধরে ধরে আলাদা আলাদা রণকৌশল তৈরি হবে। 

তবে বিধানসভা ভোটের ফল ঘোষণার পর থেকে অনেকটাই ব্যাকফুটে বিজেপি। দু’শো আসনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে থামতে হয়েছে ৭৭-এ। তার মধ্যেও অন্তত ৭ জন বিধায়ক দল বদলেছেন। ভোটের আগে তৃণমূল ছেড়ে পদ্মে যোগ দিয়ে বিধায়ক হয়েও আবার পুরনো দলে ফিরেছেন। এছাড়া তৃণমূলে ঘর ওয়াপসি হয়েছে অর্জুন সিং, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতাদের। নীচুতলার নেতা-কর্মীদের কর্মীদের মধ্যেও ভোটের আগের উল্টো স্রোত। উপনির্বাচন এবং পুরভোটেও ফল মোটেই আশানুরূপ নয়। ফলে কর্মীরা অনেকেই শীতঘুমে। যদিও পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার এবং তাঁর বান্ধবীর বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার, গরু পাচার মামলায় অনুব্রতর গ্রেফতারিতে কিছুটা চাঙ্গা হয়েছে পদ্ম কর্মীরা। তাই এই দুর্নীতির ইস্যুকেই সামনে রেখে ভোটের ময়দানে নাার প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল। কিন্তু শুভেন্দু, সুকান্তু, দিলীপবাবুরা পঞ্চায়েত ভোট পর্যন্ত সেই ইস্যু টেনে নিয়ে যেতে পারবেন কিনা, তাল নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। 

সে যাই হোক, সব দলেরই মিশন যে গ্রাম, পাখির চোখ যে গ্রাম বাংলায়, তা স্পষ্ট। যেন গ্রামে যাওয়ার নভেম্বর বিপ্লব। কিন্তু প্রশ্ন হল, গত পাঁচ বছর কি মনে পড়েনি? পাঁচ বছরে কি কেউ গ্রামে যাননি? না হলে নতুন করে ঢাক ঢোল পিটিয়ে গ্রামে যাওয়ার কী প্রয়োজন পড়ল? তবে কি গ্রাম যে অবহেলিত, সেই অবহেলিতই ছিল গত পাঁচ বছর? ভোটের পরেও কি ফের পাঁচ বছর আবার একই অবস্থা হবে?