নিয়োগ দুর্নীতিতে (Recruitment Scam) ৭ নভেম্বরের পর হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। বড় নির্দেশ দিতে পারেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Justice Abhijit Ganguly)। - অলঙ্করণ: সুবর্ণরেখা টিম |
এগিয়ে আসছে ৭ নভেম্বর। স্কুল সার্ভিস কমিশন বা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ সূত্রে এখনও এমন কোনও খবর নেই যে এক জন শিক্ষকও ইস্তফা দিয়েছেন বা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ মেনে কেউ ইস্তফা দেবেন, এমন আশা অতি উচ্চাশাবাদীও কেউ করেন বলে মনে হয় না। তার উপর প্রাথমিকে বেনিয়মে চাকরি পাওয়া ২৬৯ জনকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সেই নির্দেশের উপর অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ দিয়েছে। ফলে কিছুটা যআশা বেড়েছে দুর্নীতি করে চাকরি পাওয়া শিক্ষক- শিক্ষাকর্মীদের।
কিন্তু সেই আশা দীর্ঘস্থায়ী হবে কিনা, তা নিয়ে নিজেরাই সংশয়ে। কারণ ভিতটাই যে নড়বড়ে। অর্থাৎ যোগ্যতা ছিল না। লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে চাকরি কিনে নিয়েছেন। কোনও মেরিট লিস্ট প্রকাশ না করে শুধুমাত্র এসএমএস করে চাকরি পাওয়ার পর থেকেই সন্দেহ দানা বাঁধছিল। কিন্তু তা নিয়ে অভিযোগ তোলার জুতসই প্রমাণ বা প্রতিপক্ষ এতদিন কার্যত মেলেনি। কিন্তু একটা মামলা হওয়ার পরই একের পর এক মামলা এবং তাতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ হতেই ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়ছে বেড়াল। কার্যত রোজ রোজ পর্দাফাঁস হচ্ছে নতুন নতুন দুর্নীতির। খুলে যাচ্ছে এক একটা দুর্নীতির নতুন নতুন দিগন্ত।
আরও পড়ুন: কীভাবে ধাপে ধাপে নিয়োগ দুর্নীতির নীলনকশা? চক্রব্যূহ ভেদ করতে পারবে সিবিআই ?
শিক্ষা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। শুনানিতে নানা সময় তিনি যে সব মন্তব্য করেছেন, তা দুর্নীতিগ্রস্তদের রক্তে শীতল স্রোত বইয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। একটি টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারেও তিনি বলেছেন, ঘুষের বিনিময়ে একজন শিক্ষক বা অশিক্ষক কর্মীও যাতে শিক্ষায় না থাকে, সেই ব্যবস্থা তিনি করবেন। ইতিমধ্যেই ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়া শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মীদের একটি তালিকাও আদালতে পেশ করেছে সিবিআই। তাতে দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মী মিলিয়ে এই সংখ্যা মোট ৮ হাজার ১৬৩। তাঁদের মধ্যে নবম-দশমের শিক্ষক পদের ৯৫২ জন, একাদশ-দ্বাদশের শিক্ষক পদে ৯০৭ জন, গ্রুপ সি অশিক্ষক কর্মী ৩ হাজার ৪৮১ জন, এবং গ্রু ডি অশিক্ষক কর্মী ২ হাজার ৮২৩ জন। এদেরই চাকরি ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
একজনও ইস্তফা দেবেন?
কিন্তু বিচারপতির নির্দেশে যে কেউ ইস্তফা দেবেন না, এটা এখনই বলে দেওয়া যায়। তার কারণ একাধিক। প্রথমত, সরকারি চাকরি। সারাজীবনের খাওয়া-পরা নিশ্চিন্ত। উচ্চ মধ্যবিত্ত বা অন্তত মধ্যবিত্তের মতো জীবন। ধার দেনা করে যাঁরা ঘুষের টাকা জোগাড় করেছেন, কয়েক বছরের রোজগার থেকে সেই টাকা শোধ দিয়ে দেবেন। অনেকের হয়তো এত দিনে শোধও হয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে বাইক হবে, পাকা বাড়ি হবে। তার পর অনেকের চারচাকা গাড়িও হবে। আবার চাকরি জীবনেও প্রায় অনন্ত সুখ। নচিকেতার গানের মতো অতটা না হলেও হ্য়াপা খুব একটা নেই। বছরে ৪-৫ মাস ছুটি। আবার স্কুলে গেলেও খুব বেশি কাজের ধকল নেই। প্যারাটিচারদের ঘাড়ে বেশি করে ক্লাস চাপিয়ে নিজেরা একটু আরাম আয়েশে সময় কাটান, এমন অভিযোগ প্রায় সব স্কুলে। বেসরকারি সংস্থার মতো কথায় কথায় চাকরি যাওয়ার ধমক নেই। আর বরখাস্তের তো প্রশ্নই নেই। সূতরাং, শুধু মুখের কথায় এমন সুখের পায়রার চাকরি ছেড়ে দেবে কেউ এটা তো ভাবনারও অতীত।
আরও পড়ুন: পার্থ-অর্পিতার অপরাধ প্রমাণ করতে পারবে ইডি? দোষ প্রমাণ হলে পার্থর কত দিনের জেল?
চাকরি ছাড়লেই তো ঘুষ প্রমাণিত!
দ্বিতীয়ত, চাকরি ছাড়লেই তো স্ট্যাম্প পড়ে যাবে যে, তিনি ঘুষ দিয়ে অথবা প্রভাব খাটিয়ে চাকরি পেয়েছেন। যিনি চাকরি পেয়েইছেন ঘুষ দিয়ে, সোজা পথে হবে না বলে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন, তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়বেন, এমন দূরাশা করা বৃথা। পাশাপাশি এদের সরাসরি বরখাস্তের নির্দেশ দেননি। বরং, তাঁদের মর্জির উপর ছেড়েছেন। ফলে ছাড়তে হলে শেষ পর্যন্ত দেখে তারপরেই না হয় চাকরি ছাড়বেন, এমন আশাতেই রয়েছেন সবাই। এমনকি, আদালতের নির্দেশে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হলেও ডিভিশন বেঞ্চ, সুপ্রিম কোর্টের একাধিক আইনি রাস্তাও খোলা থাকবে। সেই লড়াইও তাঁরা চালিয়ে যাবেন, যেমন করেছেন ২৬৯ জন। তাছাড়া রয়েছে সামাজিক সম্মানের প্রশ্নও। নিজে থেকে চাকরি ছাড়ার অর্থ, সরাসরি স্বীকার করে নেওয়া যে, তিনি ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। তাতে সমাজে লোকলজ্জার মুখোমুখিও হতে হবে এবং তার মোকাবিলাও করতে হবে।
আমি তো আর ধরা পড়ব না!
তৃতীয়ত, এখনও পর্যন্ত ২৬৯ জন এবং পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতাকে যোগ করলে ২৭০ জনের চাকরি গিয়েছে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে। ২৬৯ জন ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ পেয়েছেন। তাতে অনেকে সাহস পেয়েছেন। এই সংখ্যাটা যে হিমশৈলের চূড়ামাত্র, ঘুষের বিনিময়ে চাকরি পাওয়াদের পুরো পাহাড় যে এখনও জলের তলায় সেটা পাড়ায় পাড়ায়, স্কুলে স্কুলে কান পাতলেই বোঝা যাচ্ছে। এই বিষয়টা ঘুষের বিনিময়ে চাকরি পাওয়া শিক্ষকরাও জানেন এবং বোঝেন। কার্যত ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাওয়ার জোগাড় হবে। এই বিপুল সংখ্যার মধ্যে আমি নাও পড়তে পারি বা আমি ধরা নাও পড়তে পারি, এই আশাতেও অনেকে রয়েছেন।
আরও পড়ুন: নিয়োগ দুর্নীতিতে ১০ বছর জেল খেটেছেন চৌটালা। বাংলার সঙ্গে বহু মিল
রত্নাকর দস্যুর মতো হবে না তো?
চতুর্থত, বিপুল সংখ্যক শিক্ষককে বরখাস্ত করলে তার প্রভাব রাজনীতি ও সমাজজীবনেও পড়বে। কোনও রাজনৈতিক দলকেও দলকেও হয়তো পাশে পেয়ে যাবেন এই বরখাস্ত হওয়া শিক্ষকরা। আবার যাঁরা ঘুষের বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন, তাঁরাও প্রকাশ্যে বা নেপথ্যে থেকে পাশে থাকবেন। কারণ, তাঁদের ভয় আছে যে, চাকরি গেলে তাঁদের বাড়িতে হামলা হতে পারে। আসতে পারে টাকা ফেরত দেওয়ার চাপ। ফলে তাঁরাও সামনে থেকে না হলেও পিছন থেকে সাহায্য করবেন। এখন যেমন রাস্তায় বসে আন্দোলন চলছে, তেমন আন্দোলনে নামাও অসম্ভব নয়। অবশ্য রত্নাকর দস্যুর মতোও হতে পারে। বাবা, মা, স্ত্রী সবাই যেমন রত্নাকরকে বলেছিল যে তাঁদের ভরণপোষণের দায়িত্ব তাঁর। তবে তাঁর পাপের ভাগীদার তাঁরা কেউ হবে না।
শিক্ষকরাই সন্দেহের নজরে!
কিন্তু সবারই ভয় যে ধরেছে, তার আঁচ মিলতে শুরু করেছে। পরিবার, ঘনিষ্ঠমহলে আলাপচারিতা, গোপন কথাবার্তায় উঠে আসছে আতঙ্কের ছাপ। পাড়ায় পাড়ায় গুঞ্জন, জল্পনা, আলোচনা, চর্চা শুরু হয়েছে। এলাকায় এলাকায় কে ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছে, নাম ধরে ধরে তার একটা হিসেব-নিকেশও কষতে শুরু করেছেন অনেকে। অনেককেই সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছেন। এমনকি, স্কুলের উঁচু ক্লাসের পড়ুয়াদের মধ্যেও এমন আলোচনা শুরু হয়েছে, যা সত্যিই উদ্বেগের। এর জন্য আবার যাঁরা প্রকৃতপক্ষেই পরীক্ষা দিয়ে মেধার ভিত্তিতে চাকরি পেয়েছেন, এমন শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মীদের প্রতিও অনেক সময় সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।
চাকরি গেলে ঘুষের টাকা ফেরত পাবেন?
যাঁরা অপরাধী তাঁরাও অবশ্য প্রকাশ্যে দেখানোর চেষ্টা করছেন যে তিনিও সঠিক পদ্ধতি মেনেই চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু মনে মনে তাঁরাও ভাঙতে শুরু করেছেন। ভিতরে ঢুকে গিয়েছে একটা আতঙ্কের চোরাস্রোত। একে তো চাকরি যাওয়ার ভয়, তার উপর লোকলজ্জা। তার সঙ্গে এত লক্ষ লক্ষ টাকা খোয়ানো এবং কার্যত পথে বসার আতঙ্ক তো রয়েছেই। ধার দেনা করে বা জমি-বাড়ি বিক্রি করে ঘুষের টাকা জোগাড় করেছেন। অনেকের ধারের টাকাই হয়তো এখনও শোধ হয়নি। চাকরি খোয়া গেলে সেই টাকা ফেরত পাবেন, এমনও নিশ্চয়তা নেই। এর সঙ্গে অসৎপথে পাওয়া চাকরির জন্য যে বেতন পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন, সেই টাকাও ফেরত দিতে হতে পারে, যেটা দিতে হয়েছে পরেশ অধিকারীর মেয়েকে। একেই ধার দেনা বা জমি বাড়ি বিক্রি করে প্রায় নি:স্ব অবস্থা। সবার অবস্থা অঙ্কিতার মতো নয়। আবার যদি ওই টাকা ফেরত দিতে হয়, তাহলে যে কী করবেন, রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে সেই চিন্তা। সারাক্ষণ যেন ঘাড়ের কাছে নি:শ্বাস ফেলছে এই দু:শ্চিন্তা। ৭ নভেম্বর যত এগিয়ে আসছে, আরও এগিয়ে আসছে, আরও এগিয়ে আসছে। ভিতরে ভিতরে অস্থির করে তুলছে দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষক, অশিক্ষক-কর্মীদের। শেষ পর্যন্ত পরিণতি কী হয়, সেদিকেই নজর রাজ্যবাসীর।