হরিয়ানা ও বাংলায় একই কায়দায় নিয়োগ দুর্নীতি। - নিজস্ব চিত্র |
পরিচয় গুপ্ত
৩২০৮ জন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ। নিয়ম মেনে বিজ্ঞপ্তি জারি হল, পরীক্ষা হল। নেওয়া হল ইন্টারভিউ। নিয়োগের তালিকাও প্রস্তুত। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেই তালিকা গেল পাল্টে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে। এমনই ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এসেছিল হরিয়ানায় প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে (Haryana Recruitment Scam) । সেই মামলায় ১০ বছরের জেল হয় হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোক দল (INLD) সুপ্রিমো ওম প্রকাশ চৌটালা, (Om Prakash Choutala) তাঁর ছেলে, একাধিক আমলা-সহ মোট ৫৫ জনের। ২০১৩ সাল থেকে জেল খাটার পর বর্তমানে অবশ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন চৌটালা।
বাংলার রাজনীতিতেও এখন সবচেয়ে চর্চিত ও বিতর্কিত টপিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ দুর্নীতি (West Bengal Recruitment Scam)। হাজার হাজার শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে সিবিআই (CBI) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট (Calcutta High Court)। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় (Partha Chatterjee)। ইডির হাতে গ্রেফতার হয়েছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায় (Arpita Mukherjee)। ইতিমধ্যেই মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর (Paresh Adhikary) মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর চাকরি বাতিল হয়েছে।তাঁর জায়গায় চাকরি পেয়েছেন যোগ্য প্রার্থী ববিতা সরকার। এ ছাড়াও আরও অনেকের চাকরি বাতিল হয়েছে হাইকোর্টের নির্দেশে। নতুন করে অনেক যোগ্য প্রার্থী নিয়োগ পেয়েছেন। লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। সার্ভারে পাল্টে ফেলা হয়েছে প্রাপ্ত নম্বর। পরীক্ষায় শূন্য পেয়েছেন, অথচ নম্বর বাড়িয়ে চাকরি দেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার প্রার্থীর। আদালতে সিবিআই-এর জমা দেওয়া প্রাথমিক রিপোর্টে উঠে এসেছে এমনই সব বিস্ফোরক তথ্য।
২০০০ সালে হরিয়ানায় শিক্ষক নিয়োগেও ঠিক একই রকম দুর্নীতি হয়েছিল। যার নাম ছিল জেবিটি বা জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং দুর্নীতি। বহু ক্ষেত্রেই বাংলার নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গে সেই দুর্নীতির হুবহু মিল। অথচ বাংলার কোনও সংবাদমাধ্যমে - না সংবাদপত্র না টিভি চ্যানেলে এই প্রসঙ্গ উঠলই না। হরিয়ানাতেও নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত করেছে সিবিআই। বাংলায় শিক্ষক নিয়োগে টাকার বিনিময়ে চাকরির যে অভিযোগ হরিয়ানাতেও সেই একই অভিযোগ ছিল। নিয়োগের প্যানেল বদলে ফেলার অভিযোগ এ রাজ্যে, হরিয়ানাতেও একদম ঠিক তাই হয়েছিল। দুর্নীতির শিকড়ে পৌঁছে কোথায়-কীভাবে দুর্নীতি হয়েছিল, তার খুঁটিনাটি উঠে এসেছিল সিবিআই চার্জশিটে। বাংলায় অবশ্য এখনও চার্জশিট দেয়নি সিবিআই।
হরিয়ানায় প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি?
হরিয়ানায় ৩২০৮ জন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ হয় ২০০০ সালে। কানাঘুষো চলছিল দীর্ঘদিন ধরেই। ভাল পরীক্ষা দিয়েও নিয়োগ না পেয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন বহু চাকরিপ্রার্থী। শেষ পর্যন্ত বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধেন তত্কালীন প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডের ডিরেক্টর আইএএস অফিসার সঞ্জীব কুমার। ১৯৮৯ ব্যাচের এই আইএএস অফিসার সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করেন। সঞ্জীব কুমারের অভিযোগ ছিল, যে ৩২০৯ জন নিয়োগপত্র পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ২০০০ জনের নাম জোর করে ঢোকানো হয়েছে। আরও বিস্ফোরক অভিযোগে তিনি দাবি করেন, তাঁকে চাপ দিয়ে ওই নাম ঢোকাতে বাধ্য করেন হরিয়ানার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ওম প্রকাশ চৌটালা।
এমন ভয়ঙ্কর অভিযোগ, এমন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, কার্যত গোটা দেশে তোলপাড় পড়ে যায় সেই সময়। হরিয়ানার রাজনীতিতেও প্রবল আলোড়ন পড়ে যায়। পাল্টা অভিযোগে চৌটালা দাবি করেন, আইএএস অফিসার সঞ্জীব কুমারই তাঁকে চাপ দেন প্যানেল পরিবর্তনের জন্য। এই নিয়ে শুনানি শুরু হয় সুপ্রিম কোর্টে। শেষ পর্যন্ত টু’পক্ষের শেষে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
হরিয়ানায় দুর্নীতিতেও সিবিআই তদন্ত
তদন্তে নেমে প্রথম দিকেই বিস্তর গোলোযোগ পায় সিবিআই। শুরু হয় তথ্যপ্রমাণ জোগাড়ের চেষ্টা। তদন্ত চলাকালীন চৌটালার বাডি, অফিস-সহ বহু জায়গায় তল্লাশি অভিযান চলে। উদ্ধার হয় নিয়োগ সংক্রান্ত প্রচুর নথি। বেশ কয়েক বার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় চৌটালা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের। বিশেষ করে তাঁর ছেলে অজয় চৌটালাকে। প্রায় চার বছর ধরে তদন্ত ও তথ্যপ্রমাণ জোগাড়ের শেষে ২০০৮ সালের ৬ জুন চার্জশিট পেশ করে সিবিআই। সেই চার্জশিটেই অন্যতম মূল অভিযুক্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয় চৌটালা ও তাঁর ছেলে অজয়কে। চার্জশিটে নাম ছিল হুইসল ব্লোয়ার আইএএস অফিসার সঞ্জীব কুমার-সহ আরও কয়েকজন আধিকারিকেরও।
কীভাবে দুর্নীতি?
সিবিআই চার্জশিটেই উঠে আসে দুর্নীতির প্রক্রিয়াও। চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে যে ২০০০ সালে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে আসল তালিকার পরিবর্তে একটি দ্বিতীয় তালিকা তৈরি করা হয়। তাতে প্রায় ২০০০ যোগ্য প্রার্থীর চাকরি বাতিল হয়। সেই সব যোগ্য প্রার্থীদের জায়গায় অযোগ্যদের চাকরি দিতেই নতুন তালিকা তৈরি করা হয়। কীভাবে নতুন তালিকা তৈরি হয়? সিবিআই চার্জশিটে বলা হয়, ১৮ টি জেলার প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানদের ডাকা হয়েছিল দিল্লির হরিয়ানা ভবনে এবং চণ্ডীগড়ের একটি গেস্ট হাউসে। সেখানেই অযোগ্যদের ঢুকিয়ে নতুন তালিকা বানাতে চাপ দেন চৌটালা ও তাঁর ছেলে অজয়। সেই মতো তৈরি হয় নতুন তালিকা। যাতে ঢুকে পড়েন প্রায় ২০০০ অযোগ্য প্রার্থী।
৩-৪ লাখের বিনিময়ে চাকরি!
কত টাকা নেওয়া হয়েছিল? সিবিআই চার্জশিটেই উল্লেখ করা হয়, অযোগ্য প্রার্থীদের কাছ থেকে ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকা নেওয়া হয়। ২০০০ প্রার্থীর থেকে কমপক্ষে ৩ লাখ টাকা করে নিলেও মোট অঙ্ক দাঁড়ায় ৬০ কোটি টাকা। সেই টাকা হাত ঘুরে পৌঁছেছে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর ছেলের কাছে। তথ্যপ্রমাণ দিয়ে এই তথ্য চার্জশিটে উল্লেখ করে সিবিআই। আরও বলা হয়, অযোগ্যদের চাকরি দিতে জাল নথিপত্র জমা দেওয়া হয়েছিল। সেই নথি জমা দিয়েছিলেন খোদ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চৌটালা ও তাঁর ছেলে অজয়।
সপুত্র চৌটালার ১০ বছরের জেল
শুরু হয় বিচার প্রকিয়া। প্রায় পাঁচ বছর ধরে শুনানি শেষে চৌটালা ও তাঁর ছেলেকে ভারতীয় দণ্ডবিধি এবং প্রিভেনশন অব করাপশন অ্যাক্টে দোষী সাব্যস্ত হন। অবশেষে ২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি রায় দেয় হরিয়ানার বিশেষ সিবিআই আদালত। রায়ে চৌটালা ও তাঁর ছেলে অজয়কে ১০ বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন বিচারক। সপুত্র চৌটালা-সহ এই দুর্নীতিতে দোষী সাব্যস্ত হন হুইসল ব্লোয়ার আইএএস অফিসার সঞ্জীব কুমারও। তারও একই সাজা হয়। মামলায় মোট অভিযুক্ত ছিলেন ৬৪ জন। তাঁদের মধ্যে বিচার ও তদন্ত চলাকালীন ৬ জনের মৃত্যু হয়। একজনকে বেকসুর খালাস করে আদালত। চৌটালা ও অজয় ছাড়াও আরও ৫৫ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন ১৬ জন মহিলাও।
বাংলাতেও হরিয়ানার কায়দায় দুর্নীতি?
ঘটনাচক্রে বাংলায় শুধু প্রাথমিক নয়, হাইস্কুলে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মী নিয়োগেও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে মোটা টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার। নিয়োগের প্যানেল, চাকরিপ্রার্থীদের উত্তরপত্র থেকে ওএমআর শিটে ব্যাপক কারচুপি, বেনিয়মের ভুরি ভুরি অভিযোগ উঠে আসছে। এমনকি, সাদা খাতা জমা দিয়েও অনেকে চাকরি পেয়েছেন শুধুমাত্র টাকার বিনিময়ে। এই দুর্নীতির মোডাস অপারেন্ডি হরিয়ানার দুর্নীতির মতোই। বলা যায় আরও ব্যাপক আকারের দুর্নীতির ইঙ্গিত মিলছে সিবিআই তদন্তে। তদন্তের সূত্রে উঠে আসছে একের পর এক বিস্ফোরক তথ্য। যা কার্যত হার মানায় হরিয়ানার দুর্নীতিকেও। কারণ এখানে চাকরির জন্য যে টাকা নেওয়া হয়েছে তার অঙ্ক আরও অনেক বেশি। শিক্ষামহলে কানাঘুষো, প্রাইমারির ক্ষেত্রে ১০-১৫ লক্ষ এবং হাইস্কুলের ক্ষেত্রে ১৫-২০ লক্ষ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে চাকরি। সময়ের নিরীখে টাকার মূল্যমান হিসেব করলে অবশ্য হরিয়ানা-বাংলা প্রায় কাছাকাছিই থাকবে। পার্থক্য আরও একটা আছে। চৌটালার বাড়িতে বা কোথাও বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা পাওয়া যায়নি, যাও পাওয়া গিয়েছে পার্থর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অর্পিতার দুই ফ্ল্যাট থেকে।
কী হবে বাংলায়?
হরিয়ানার ঘটনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, তদন্তপ্রক্রিয়া শেষ করা, তারপর চূড়ান্ত চার্জশিট দেবে সিবিআই। তার পর শুরু হবে বিচারপ্রক্রিয়া। সব মিলিয়ে আরও অন্তত কয়েক বছর সময় লাগবে বলেই মত আইনজ্ঞ মহলের। শেষ পর্যন্ত সিবিআই চার্জশিটে কারা কারা দোষী সাব্যস্ত হন বা কেউ দোষী সাব্যস্ত হন কিনা সেই দিকে নজর থাকবে রাজ্যবাসীর। পাশাপাশি নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত প্রক্রিয়ায় আরও কেউ গ্রেফতার হন কিনা বা কেউ জামিন পান কিনা, সেই দিকে নজর থাকবে সুবর্ণরেখার। নজর থাকবে গোটা বাংলারও।