রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস (Governor C V Anand Bose) এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা (State Election Commissioner Rajiv Sinha)। |
জয়েনিং রিপোর্ট কী? এটা হল কাজে যোগদানের রিপোর্ট। অর্থাৎ কোনও কাজে যোগদানের শেষ ধাপ। কমিশনারের ক্ষেত্রে যেমন রাজ্যপাল নিয়োগ করলেন। তার পর কমিশনার শপথ নিলেন। অর্থাৎ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হল। কিন্তু তার পর তিনি যে কাজে যোগদান করেছেন, সেটা জানাতে হয় নিয়োগকর্তাকে। যে কোনও চাকরির ক্ষেত্রেও যেমন নিয়ম। লিখিত পরীক্ষা থাকলে তাতে পাশ করা, তার পর ইন্টারভিউ এবং অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাওয়া। সেটা পাওয়ার পর যে দিন কাজে যোগ দেবেন, সে দিন কাজে যোগ দিয়েছেন, এই মর্মে নিয়োগ কর্তাকে জানাতে হয়। তাকেই বলে জয়েনিং রিপোর্ট। মাথায় রাখতে হবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট রিপোর্ট বা ফাইল কিন্তু নয়। রাজীব সিনহাও সেই নিয়ম মেনে সেই জয়েনিং রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন। এবার সেই জয়েনিং রিপোর্টই ফেরত পাঠিয়েছেন সি ভি আনন্দ বোস।
কিন্তু প্রশ্ন হল কেন ফেরত পাঠালেন রাজ্যপাল? রাজ্যপাল বোস অবশ্য জানিয়েছেন, কমিশনার জনসাধারণকে হতাশ করেছেন বলেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত। তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমিই তাঁকে (রাজীব সিনহা) নিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু তিনি জনগণকে হতাশ করেছেন।’’ অর্থাৎ তিনি যে কমিশনারের উপর মোটেই সন্তুষ্ট নন, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন।
রাজ্যপাল কি বরখাস্ত করতে পারেন?
কিন্তু বোঝালেই তো হল না। নিয়োগের যেমন পদ্ধতি আছে, তেমনি নির্বাচন কমিশনারের মতো সাংবিধানিক পদে একবার নিয়োগ দিলে অত সহজে বরখাস্ত করা যায় না। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতির মতে, একবার নিযুক্ত হবার পর রাজ্য বা জাতীয় নির্বাচন কমিশনারকে বরখাস্ত করতে হলে ইমপিচমেন্ট করতে হয়। যেমনটা বিচারপতিদের ক্ষেত্রে হয়। যদিও বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এটাও বলেছেন যে, এমন সাংবিধানিক সঙ্কট কখনও তৈরি হয়নি। ফলে সঠিক পদ্ধতি কী, তা নিয়ে আইনগত ও সাংবিধানিক দিক আরও খুঁটিয়ে দেখতে হবে।
আফসোস করছেন রাজ্যপাল?
ফলে রাজ্যপাল এখন কার্যত নিজের জালেই নিজে ফেঁসেছেন। এমন একজনকে কমিশনার নিয়োগ করেছেন, যাঁর কাজকর্মে হাজারো প্রশ্ন। দলদাস, ক্রীতদাস, কুম্ভকর্ণের মতো আচরণ করছেন বলে অভিযোগ আসছে নানা মহল থেকে। আদালত রোজ ধমক দিচ্ছে, তিরস্কার করছে। এমনকি, ইস্তফা দেওয়ার কথা পর্যন্ত বলেছে হাইকোর্ট। তার পরেও হেলদোল নেই। কমিশনার কার্যত নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন।
কিন্তু রাজ্যপালের তো এখন রুষ্ট হয়েও কার্যত কোনও লাভ নেই। কারণ, তিনি নিজেই জেনেশুনে বিষ পান করেছেন। তিনটি নাম ছিল। তার মধ্যে রাজীব সিনহা নবান্নের সবচেয়ে অনুগত বলে কার্যত তিনিও জানতেন। তার পরও কেন রাজীব সিনহার নামেই সিলমোহর দিলেন? এই প্রশ্নেই উঠে আসছে সেটিংয়ের তত্ত্ব। অর্থাৎ কমিশনার নিয়োগেও সেটিং হয়েছে।
রাজীব সিনহার নিয়োগে সেটিং?
কমিশনার নিয়োগের ঠিক আগের পরিস্থিতির কথা মনে করুন। রাজ্যের ১১টি কলেজের উপাচার্য নিয়োগ করে ফেললেন রাজ্যপাল। অথচ সেই খবর আগে থেকে জানতেই পারেনি নবান্ন। অথবা রাজ্যপাল জানাননি। তাই নিয়ে শাসক দল তৃণমূলও রাজ্যপালের পিছনে কার্যত হাত ধুয়ে পড়েছিলেন। আইনি রাস্তা নেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। কিন্তু তার পর আর এগোয়নি রাজ্য়। উপাচার্যরা যে মামলা করেছেন, তার পার্টি হয়েছে রাজ্য সরকার। কেন রাজ্যপালের বিরুদ্ধে আইনি পথে হাঁটল না রাজ্য?
৩ জনের মধ্যে কেন রাজীব সিনহা?
এখানেই আসছে কমিশনার নিয়োগে সেটিংয়ের তত্ত্ব। বিভিন্ন সূত্রে সবর্ণরেখা নিউজ জানতে পেরেছে, রাজ্যপাল কমিশনার নিয়োগের জন্য নবান্নের কাছে নাম চেয়ে পাঠান। প্রথমে পাঠানো হয় রাজীব সিনহার নাম। কিন্তু রাজ্যপাল আরও একটি নাম চেয়ে পাঠান। রাজ্য দ্বিতীয় নাম পাঠায়। এর পর আরও একটি নাম চেয়ে পাঠান আনন্দ বোস। নবান্নও পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় নাম বাদ দিয়ে সেই প্রথম নাম, অর্থাত রাজীব সিনহার নামেই সিলমোহর দেন রাজ্যপাল।
গোয়েন্দা রিপোর্ট উপেক্ষা করেই নিয়োগ?
এই ধরনের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজ্যপাল সেন্ট্রাল আইবি বা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের কাছ থেকে রিপোর্ট চেয়ে পাঠান। সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা এর মধ্যে এক জনের সম্পর্কে অত্যন্ত ভাল রিপোর্ট দেন। তাঁর কাজের ধরন, নিষ্ঠা, সততা সন্দিহান। আনুগত্যের প্রশ্নেও কার্যত রাজীব সিনহার বিপরীত অবস্থান। অথচ রাজ্যপাল তাঁকে নিয়োগ না দিয়ে রাজীব সিনহাকেই কমিশনার নিয়োগের সুপারিশ করেন। নবান্ন তো প্রথম থেকেই রাজীব সিনহাকেই চাইছিল।
সমঝোতা?
কিন্তু প্রশ্ন হল, রাজ্যপাল কেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের রিপোর্ট কার্যত উপেক্ষা করে রাজীব সিনহার পক্ষে মত দিলেন? সূত্রের খবর, এটাই কার্যত সমঝোতা ছিল। রাজ্যপাল যে ১১ উপাচার্য নিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের বিষয়ে রাজ্য আর উচ্চবাচ্য করবে না। পরিবর্তে রাজ্যপালকে রাজীব সিনহার নামে সিলমোহর দিতে হবে। এই শর্ত নবান্ন নাকি রাজভবন, কোন পক্ষ থেকে এসেছিল, সেটা অবশ্য স্পষ্ট করা সম্ভব হয়নি। তবে বিভিন্ন সূত্র মিলিয়ে একে একে দুই করলে এমনটাই সমঝোতা হয়েছিল বলে ওয়াকিবহাল মহল সূত্রের খবর।