পার্থ-অর্পিতার অপরাধ প্রমাণ করতে পারবে ইডি? দোষ প্রমাণ হলে পার্থর কত দিনের জেল?

Partha Arpita and Money Representational Image
পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ভবিষ্যৎ কী? (গ্রাফিক: সুবর্ণরেখা টিম)। 
পরিচয় গুপ্ত

রাজনীতির সম্ভবত সবচেয়ে বড় কলঙ্কিত অধ্যায় ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি (Watergate Scam)। আকারে হয়তো আরও অনেক বড় কেলেঙ্কারি আছে, কিন্তু ফাঁস হওয়া এবং তার পরিণামের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি। মার্কিন মুলুকে শুধু নয়, গোটা বিশ্বের কাছেই এমন দুর্নীতি এবং তার জেরে গোটা মার্কিন মুলুকের ক্ষমতা পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার নজির খুব কমই আছে। 

আমাদের রাজ্যে এখনও পর্যন্ত আড়ে বহরে সবচেয়ে বড় নিয়োগ দুর্নীতি (Recruitment Scam)। দু’-পাঁচ লাখ বা ১০-২০ লাখের মতো দুর্নীতি এ রাজ্যে মাঝেমধ্যে উঠে এসেছে বটে, কিন্তু এত নগদ টাকা এর আগে কখনও উদ্ধার হয়নি। সারদা, রোজভ্যালি, এমপিএস-এর মতো কেলেঙ্কারি টাকার অঙ্কে নিয়োগ দুর্নীতির চেয়ে বড় (পার্থ-অর্পিতার যা নগদ টাকা, সোনাদানা ও সম্পত্তি উদ্ধার হয়েছে, তার হিসেবে। টাকা অন্যত্র সরানো হলে বা পাচার হলে অন্য কথা)। কিন্তু চিটফান্ডের দুর্নীতিতেও এত নগদ টাকা উদ্ধারের ছবি এ রাজ্য দেখেনি। 

প্রশ্ন হল, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের (Partha Chatterjee) কি শাস্তি হবে? এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (Enforcement Directorate) বা ইডি কি দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারবে? শাস্তি হলেই বা কী অথবা কত দিনের হতে পারে? এ সব প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে থাকলেও তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যেতেই পারে।

এত টাকা আগে দেখেনি বাংলা

প্রথমে ঘটনাক্রম বুঝে নেওয়া যাক। মাঝরাতে ইডির অভিযান পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। একই সঙ্গে ইডির হানা অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের (Arpita Mukherjee) হরিদেবপুরের ফ্ল্যাটে। পার্থ গ্রেফতার হলেন টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রির অভিযোগে। অর্পিতার দুই ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হল ৫০ কোটিরও বেশি নগদ টাকা। সঙ্গে গয়না, সোনাদানা, বিদেশি মুদ্রা। টাকার উত্স কী? সঠিক ব্যাখ্যা নেই পার্থ বা অর্পিতার কাছে। পার্থ বলছেন তিনি জানেন না, কার টাকা। অর্পিতারও দাবি, কে তাঁর ফ্ল্যাটে টাকা রেখে গিয়েছেন, তা তিনি জানেন না। 

পার্থর পদে পদে বিপদ। কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে অর্পিতার দুই ফ্ল্যাট থেকে। সেই টাকা পার্থর বলে দাবি করেছেন অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। এমনই দাবি করেছে ইডি। প্রথমদিকে ভয়ে স্বীকার করেননি বলে ইডির কাছে দেওয়া বয়ানে দাবি করেছেন অর্পিতা। পাশাপাশি এমন তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করেছেন ইডি আধিকারিকরা, যাতে চাকরি দুর্নীতি কার্যত জলের মতো স্পষ্ট। তার মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের নথি, হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের অংশ ইত্যাদি। আবার টাকা দিয়েও চাকরি পাননি বা পেয়েছেন এমন কয়েকজনের সাক্ষ্যও জোগাড়ের চেষ্টায় রয়েছেন ইডি আধাকারিকরা। একটি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে হাইকোর্টের বর্ষীয়ান আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ বলেছিলেন, পার্থর ছাড়া পাওয়া খুব কঠিন। 

ইডির হেফাজতে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। - নিজস্ব চিত্র
কিন্তু প্রশ্ন হল, প্রমাণ হওয়ার পর কী? অর্থাৎ যদি দুর্নীতি প্রমাণ হয়, তাহলে  কত দিনের জেল হতে পারে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর? ইন্ডিয়ান পিনাল কোড বা ভারতীয় দণ্ডবিধি ১৯৬০ (Indian Penal Code 1960) অনুযায়ী নির্দিষ্ট ধারায় দুর্নীতি প্রমাণে শাস্তির বিধান রয়েছে। তা ছাড়াও শুধুমাত্র দুর্নীতি বিরোধী আলাদা দু’টি আইন তৈরি হয়েছে পরবর্তীকালে।

প্রিভেনশন অব করাপশন অ্যাক্ট ১৯৮৮ (Prevention of Corruption Act 1988) 

এই আইনে মূলত বেআইনি সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত বা আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি বিষয়ক। এই আইন অনুযায়ী বেআইনি সম্পত্তি কেনাবেচা বা লেনদেনের প্রমাণ মিললে সর্বোচ্চ তিন বছরের শাস্তি এবং অথবা জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। বেআইনিভাবে কেনা সম্পত্তি ক্রোক করার অধিকার রয়েছে সরকারের। তার জন্য দোষী কোনও টাকা পাবে না। 

দ্য প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট ২০০২ (The Prevention of Money Laundering Act 2022) 

এক কথায় বেআইনি লেনদেন বা দুর্নীতি সংক্রান্ত আইন। এই আইনে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তিন বছর থেকে সাত বছর পর্যন্ত জেল এবং পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। তবে এই বেআইনি লেনদেন ড্রাগ বা মাদক সংক্রান্ত হলে সাজার সর্বোচ্চ মেয়াদ ১০ বছর পর্যন্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে সাজা হয় নার্কোটিক্স ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্সেস অ্যাক্ট ১৯৮৫ ধারায়। এছাড়াও এর সঙ্গে প্রতারণা, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মতো ধারাও যোগ হতে পারে। 

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, যে আইনেই বিচার হোক, সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর। সঙ্গে জরিমানা হতে পারে। তাও সর্বোচ্চ জরিমানার পরিমাণ পাঁচ লক্ষ টাকা, যা উদ্ধার হওয়া টাকা সম্পত্তির কাছে কার্যত কিছুই নয়। বিহারে পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি শিক্ষা দুর্নীতির চেয়ে বড় অঙ্কের ছিল (যদিও এত বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা উদ্ধার হয়নি)। সিবিআই তদন্তের শেষে বিচারে ওই মামলায় লালুপ্রসাদের জেল হয় পাঁচ বছরের। জেল থেকে ছাড়াও পেয়ে আবার সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরেছেন লালুপ্রসাদ। যদিও আপাতত প্রার্থী হতে পারবেন না। কারণ আইন অনুযায়ী সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরও ৬ বছর কোনও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা অর্থাৎ প্রার্থী হওয়া যায় না। 

বিচারের বাণী

আইন অনুযায়ী কোনও অপরাধীকে আলাদা আলাদাভাবে সাজা দেওয়া যায় না। একটা শাস্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অন্য শাস্তি শুরু হবে এমন আইন নেই, বরং সব শাস্তি একসঙ্গে চলে। অর্থাৎ ধরা যাক, কোনও মামলায় কারও এক বছর, অন্য কোনও মামলায় পাঁচ বছরের সাজা হল। সে ক্ষেত্রে মোট শাস্তি পাঁচ বছরই হবে, ছ’বছর নয় (অবশ্য এক মামলার মেয়াদ শেষ করে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অন্য অপরাধ করলে আলাদা কথা)। তা ছাড়া বিচারাধীন অবস্থায় যতদিন হেফাজতে থাকেন কোনও অপরাধী, সাজার মেয়াদ তার থেকে বাদ যায়। এছাড়াও রয়েছে ছুটি। মোট সাজার মেয়াদ থেকে সপ্তাহে এক দিনের ছুটিও বাদ যায়।

দোষ প্রমাণ হলে পার্থর কত দিনের জেল? 

ফলে সব মিলিয়ে সাত বছরের বেশি জেল খাটতে হবে না পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। এখন পার্থর বয়স ৭০ বছর। আইনজীবীদের একাংশের মতে, যদি ধরেও নেওয়া যায়, সর্বোচ্চ সাজা হবে, তাতেও সাত বছরের বেশি জেলে থাকতে হবে না পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। তার পর জেল থেকে বেরিয়ে আরও ছ’বছর প্রার্থী হতে পারবেন না। এখন থেকে যদি ধরা যায়, তাহলে সাত বছরের সাজা এবং ছ’বছর অর্থাৎ ৮৩ বছর বয়স পর্যন্ত পার্থ আর কোনও ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না। যদিও রাজনীতি করতে বাধা নেই। 

পার্থর রাজনৈতিক কেরিয়ারে দাঁড়ি!

পার্থকে দল থেকে আপাতত সাসপেন্ড করে রাখা হয়েছে। নির্দোষ প্রমাণ করে ফিরে আসতে পারলে আবার দলে ফিরিয়ে নেওয়া হবে বলা হয়েছে তৃণমূলের তরফে। কিন্তু পার্থর সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর হলে তার পর তাঁর বয়স হবে প্রায় ৭৭ বছর। একে এত বয়স, তার উপর সাজাপ্রাপ্ত। ফলে তখন কি আর তৃণমূল ফেরত নেবে পার্থকে। আবার যদি বেকসুর খালাসও পান, তাতেও বিচার হতে অন্তত আরও বেশ কিছু দিন, এমনকি কয়েক বছরও জেল হেফাজতে থাকতে হতে পারে পার্থকে। কারণ ইতিমধ্যেই ইডি এক দফা চার্জশিট পেশ করেছে আদালতে। ফলে তাঁকে হেফাজতে রেখেই বিচার হবে। সেক্ষেত্রেও ছাড়া পাওয়ার পর পুনরায় রাজনীতিতে আগের জায়গা ফিরে পাওয়া কঠিন। আদালতে দোষ প্রমাণ না হলেও দলের অনেকেও সন্দেহের চোখে দেখবেন। তাছাড়া তত দিনে পার্থর জায়গাও দলে পূরণ হয়ে যাবে। ফলে পার্থর রাজনৈতিক কেরিয়ারে কার্যত দাঁড়ি পড়ে গেল বলেই ভবিষ্যদ্বাণী করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং আইনজ্ঞ মহল। 

নাকতলার পুজোয় পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। - সৌজন্য টুইটার। 
অর্পিতার বিষয়টা অনেকটা গোলমেলে। তাঁর ফ্ল্যাট থেকেই টাকা উদ্ধার হয়েছে। তাঁর জ্ঞাতসারে হয়েছে সেটা প্রমাণ হলে অপরাধের অংশীদার হিসেবে তাঁর কড়া শাস্তি হতে পারে। কিন্তু সেটা প্রমাণ করা কঠিন। একমাত্র পার্থ যদি বলেন অর্পিতা সব জানতেন, তাহলে তদন্তকারীদের কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও লক্ষণ নেই। আবার অর্পিতা রাজসাক্ষী হলে শাস্তির মেয়াদ কম হতে পারে।

ওয়াটারগেট নয়

শুরুতেই যে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কথা বলেছিলাম এই কারণেই। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি হয়েছিল প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সময়ে ১৮৭২ সালে। নিক্সন প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন। অভিযোগ উঠেছিল, নিক্সনের দল ও প্রশাসনের কয়েকজন ব্যক্তি বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটদের সদর কার্যালয় ওয়াটার গেট ভবনে আড়ি পেতেছিলেন। পরবর্তীকালে সেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়। নিক্সনও দোষ স্বীকার করেন এবং ১৯৮৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পদ থেকে ইস্তফা দেন। নিক্সনের আগে কেলেঙ্কারি বা দুর্নীতির জেরে কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্টের ইস্তফার নজির নেই। বিচারে মোট ৪৩ জনের কারাবাস হয়। নিক্সনেরও সাজা হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে তাঁর উত্তরসূরি গ্যারল ফোর্ড মার্কিন প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসার পর নিক্সনের অপরাধ মার্জনা করে দেন। 

প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। - সৌজন্য টুইটার। 

অনেকেই হয়তো মনে করছেন, মার্কিন মুলুক এবং সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দেওয়া এই ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির মতো কাণ্ড ঘটতে পারে পার্থর ক্ষেত্রে। তৄণমূলের ক্ষেত্রে পার্থর গ্রেফতারি এবং টাকা উদ্ধারের ঘটনা কিছুটা অস্বস্তির বটে। তবে রাজনৈতিক মহলের মতে, তা ইতিমধ্যেই অনেকটা সামলেও নিয়েছে। যদিও শেষরক্ষা হবে কিনা, তার প্রমাণ মিলবে আগামী বছরের পঞ্চায়েত ভোট, তার পরের বছর লোকসভা নির্বাচন এবং ২০২৬-এ বিধানসভার ভোটে।