নিয়োগ দুর্নীতিতে (Recruitment Scam) মিডলম্যানের মাধ্যমে তোলা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। -কোলাজ: সুবর্ণরেখা টিম |
শিক্ষামন্ত্রী থাকা অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় (Partha Chatterjee)। তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর দুই ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয়েছে ৫০ কোটিরও বেশি নগদ টাকা। পর পর গ্রেফতার হয়েছেন স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য (Subiresh Bhattacharya), কমিশনের উপদেষ্ঠা শান্তিপ্রসাদ সিনহা (Shantiprasad Sinha), প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের অপসারিত সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য (Manik Bhattacharya)-সহ আরও কয়েকজন। কীভাবে তৃণমূল স্তর থেকে শিক্ষা দফতরের শীর্ষ স্তর পর্যন্ত দুর্নীতির পিরামিড তৈরি হয়েছিল, তারও একটা রূপরেখা আঁচ করতে পেরেছেন তদন্তকারী অফিসাররা।
পরীক্ষার আগে ও পরে দুর্নীতি!
তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, পাঁচটি ক্ষেত্রেই দুর্নীতি হয়েছে কার্যত দু’টি ধাপে। প্রথম ধাপে পরীক্ষার আগেই রফা। এই শ্রেণির চাকরিপ্রার্থীরা পরীক্ষায় বসার আগেই নির্ধারিত অঙ্কের টাকার পুরোটা বা আংশিক দিয়ে দেন। তাঁদের বলে দেওয়া হয়, নাম, রোল নম্বর-সহ যাবতীয় তথ্য লিখে বাকিটা সাদা খাতা বা ওএমআর শিট জমা দিতে। লেখার খুব ইচ্ছা হলে পুরোপুরি নিশ্চিত জানা উত্তরই লিখতে হবে। চাকরিপ্রার্থীরাও সেই অনুযায়ী খাতা জমা দেন। যাঁরা আংশিক টাকা দিয়েছিলেন, চাকরির নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ার পর বাকি টাকা দিয়েছেন তাঁরা।
দ্বিতীয় ধাপে দুর্নীতি হয়েছে নিয়োগের পরীক্ষার পরে। পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পরে যাঁরা যোগাযোগ করেছেন, দুর্নীতিবাজদের কাছে তাঁদের কাজটা ছিল আরও কঠিন, আরও চ্যালেঞ্জের। কারণ ওএমআর শিট বা উত্তরপত্র জমা পড়ে গিয়েছে। সেখানে আর কিছু করার উপায় নেই। কিন্তু দুর্নীতিবাজরা ঠিকই উপায় বের করেছেন। কারসাজি করেছেন সার্ভারে তথ্য আপলোডের সময়। অর্থাৎ কম্পিউটারে নম্বর আপলোডের সময়। সেখানে ৫ হয়েছে ৫০ অথবা ৪ পাল্টে গিয়ে হয়েছে ৬০। আর ওএমআর শিট বা উত্তরপত্রও নাকি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। হাইকোর্টে একটি মামলার সূত্রে এমনটা জানিয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ।
আরও পড়ুন: গ্রেফতার তৃণমূলের মানিক, বিএড কলেজেও জালিয়াতি! মানিকের কনটাক্ট লিস্টে রহস্যময় RK, DD কে?
০, ১, ২ পেয়েও শিক্ষক!
প্রথম যে মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, ওই দিনই সার্ভারের দখল নিতে চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয় সিবিআই। আদালতের নির্দেশে রাতারাতি কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী সিআইএসএফ দিয়ে মুড়ে ফেলা হয় স্কুল সার্ভিস কমিশন চত্বর। তালা দিয়ে সিল করে দেওয়া হয় সার্ভার রুম। ফলে দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ারও কোনও উপায় ছিল না। প্রথম চার্জশিটের সঙ্গে সিবিআই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইলেকট্রনিক্স বা ডিজিটাল নথি জমা দিয়েছে। সেটা হল, সার্ভারের তথ্য। একটি পেশাদার তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাকে দিয়ে সার্ভারের তথ্য পরীক্ষা করিয়েছে সিবিআই। তাতে দেখা গিয়েছে, রুমাল থেকে বেড়াল হয়ে যাওয়ার নজির ভুরি ভুরি। হাজারে হাজারে। শূন্য এক বা দুই নম্বর পাওয়া পরীক্ষার্থীর নম্বর এমনভাবে বদল করা হয়েছে, যাতে চূড়ান্ত তালিকায় তাঁদের নাম আসতে কোনও অসুবিধা না হয়।
বুথ স্তর থেকে দুর্নীতি!
পুরো চক্র যে কারও একার পক্ষে করা এবং তা সামলে রাখা সম্ভব নয়, তা এই দুর্নীতির বহর দেখলেই বোঝা যায়। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, চক্রের কুশীলবরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে একেবার বুথ স্তর থেকে শিক্ষা দফতরের শীর্ষ স্তর পর্যন্ত। কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসনও। আর ছিল মিডলম্যান। এমনই এক মিডলম্যানকে নিউটাউন এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে ইডি। পার্থর আত্মীয় ওই ব্যক্তিরও বহু সম্পত্তির হদিশ মিলেছে। বুথ স্তরে এই মিডলম্যান, প্রভাবশালী বা নেতারাই চাকরিপ্রার্থীদের টাকার বিনিময়ে চাকরির টোপ দিয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে আবার প্রার্থীরাই যোগাযোগ করেছেন। এই সূত্রেই উঠে এসেছে বাগদার রঞ্জনের কথা। যার কথা বলেছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও তৃণমূল নেতা এবং প্রাক্তন সিবিআই কর্তা উপেন বিশ্বাসের কথায়। এমন হাজার হাজার রঞ্জন ছড়িয়ে রাজ্যের সব জেলায়, সব ব্লকে। এই মিডলম্যানরা টাকা তুলে দিতেন স্থানীয় নেতাদের। স্থানীয় নেতারা সেই টাকা পৌঁছে দিতেন উপর মহলে।
আরও পড়ুন: পার্থ-অর্পিতার অপরাধ প্রমাণ করতে পারবে ইডি? দোষ প্রমাণ হলে পার্থর কত দিনের জেল?
টাকা তোলার পর এবার জেলায় জেলায় বুথ স্তর থেকে চাকরিপ্রার্থীদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেই তালিকা নানা মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে শিক্ষা দফতরে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় অন্য জায়গায়, তৃণমূলের অন্দরমহলের খবর, যে সংখ্যায় শূন্যপদ তার চেয়ে অনেক বেশি প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা তোলা হয়েছে। ফলে কাকে বাদ দেওয়া হবে, তাই নিয়েও এক প্রস্থ ঝাড়াই বাছাই হয়েছে।
টাকা দিয়েও চাকরি পাননি অনেকে, বাড়ছে ক্ষোভ
কিন্তু টাকা দিয়েও কি সবাই চাকরি পেয়েছেন। উত্তর বলার অপেক্ষা রাখে না, সকলেরই জানা। পাড়ায় পাড়ায়, ব্লকে ব্লকে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে টাকা দিয়েও চাকরি পাননি তাঁরা। এতদিন নেতা-প্রভাবশালীরা নানা স্তোকবাক্য দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছিলেন। যেমন। এবার না হোক পরের বার হবে, অথবা স্কুলের চাকরির জন্য টাকা দিয়েছেন তো, স্কুলে না হলেও অন্য কোনও সরকারি চাকরি হবে। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছিলেন না চাকরিপ্রার্থীরা। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী থাকা অবস্থায় পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার, পার্থর বান্ধবীর দুই ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার এবং হাইকোর্টে এক একটি মামলায় দুর্নীতির হিমশৈলের অংশের পর্দাফাঁস হতেই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। বাড়ছে ক্ষোভ। ফুঁসছেন টাকা দেওয়া প্রার্থীরা। নেতাদের বা প্রভাবশালীদের বাড়িতে হত্যে দিচ্ছেন। ওই ছেলেভোলানো কথায় আর চিঁড়েও ভিজতে চাইছে না। অনেক ক্ষেত্রে মারধর করা হচ্ছে। টাকা নিয়েছেন এমন অনেকে এলাকা ছাড়া।
পর্যবেক্ষকদেরক একাংশের মতে, নিয়োগ প্রক্রিয়ার এই শম্বুকগতি হয়তো এই লাগামহীন, চক্ষুলজ্জাহীন দুর্নীতির জন্যই। হয়তো শূন্যপদ যত, তার থেকেও বেশি মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলে ফেলেছেন এই দালাল, মিডলম্যান, প্রভাবশালী বা নেতারা। ফলে কাকে চাকরি দেওয়া হবে, কাকে বাদ দেওয়া হবে, পরের বারের জন্য কার নাম রাখা হবে, এই সব জটিল অঙ্ক কষতে গিয়েই দেরি হয়েছে।
এত টাকার দুর্নীতি!
কত টাকার দুর্নীতি? শুধু প্রাথমিকের ক্ষেত্রেই ধরা যাক। মানিক ভট্টাচার্য বোর্ড সভাপতি থাকাকালীন তিন দফায় নিয়োগ হয়েছে প্রায় ৫৮ হাজার। ধরে নেওয়া যাক, এর অর্ধেক প্রার্থী (আদপে সংখ্যা আরও বেশি বা পুরোটাও হতে পারে) টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। প্রাথমিকে চাকরির দর ছিল ৭ থেকে ১০ লক্ষ টাকা। মনে করা যাক গড়ে প্রত্যেক প্রার্থী ৮ লাখ টাকা দিয়েছেন। তাহলে মোট দুর্নীতির টাকার অঙ্কটা শুনলে অনেক কিছুই মাথায় উঠবে। ২৩২০ কোটি টাকা। যদি এক চতুর্থাংশ প্রার্থীরও টাকা দিয়ে চাকরি হয়, তাহলে দুর্নীতির অঙ্ক দাঁড়াবে এক হাজার একশো ষাট কোটি টাকা। উদ্ধার হয়েছে মাত্র ৫০ কোটি। বাকি টাকা কোথায় গেল? খুঁজছেন তদন্তকারীরা।
ঘুষ দিয়ে পাওয়া চাকরি থাকবে?
প্রশ্ন হল, ন্যায়বিচার হবে তো? এই দুর্নীতি করে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের চাকরি থাকবে? যাঁরা এই ভাবে ঘুষের বিনিময়ে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের কিন্তু ভিতরে ভিতরে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হতে শুরু করেছে। চাকরি থাকবে কিনা, গ্রাস করছে এই আতঙ্ক, হতাশা। উল্টোদিকে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ হবে তো? এই জটিল চক্রব্যূহ ভেদ করার কাজটা কিন্তু পেশাদার তদন্তকারীদের কাছেও অত্যন্ত কঠিন। কারণ, আসল পরীক্ষার্থীদের ওএমআর শিট বা উত্তরপত্রই যদি না থাকে অথবা থাকলেও বদলে ফেলা হয়ে থাকে, তাহলে আর কীভাবে তার সংশোধন সম্ভব? আবার পুরো প্যানেল বাতিল করাও সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে, যাঁরা আক্ষরিক অর্থেই যোগ্য প্রার্থী এবং মেধার ভিত্তিতে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের চাকরিও বাতিল হবে। তাঁরা আবার আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। সে এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
আবার ওই পরীক্ষায় টাকার বিনিময়ে অযোগ্য প্রার্থীদের ঢোকাতে গিয়ে অনেক যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিতে হয়েছে। তাঁদের অনেকের চাকরির বয়স ৪০ বছরের বেশিও হয়ে যেতে পারে। তাঁদের কী হবে? নিয়োগ দুর্নীতিতে এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন শীর্ষস্থানীয় নেতা-মন্ত্রী ও পদাধিকারীরা। কিন্তু নীচুতলার যাঁরা ওই মিডলম্যান, প্রভাবশালী বা নেতা সেই পিরামিডের গোড়া বা হিমশৈলের তল পর্যন্ত পৌঁছনো যাবে কিনা, রয়েছে সেই প্রশ্নও। অর্থাৎ প্রকৄত ন্যায়বিচার হওয়া সত্যিই খুব দুরূহ ব্যাপার। তবু এত সব জটিলতাকে পাশে সরিয়ে রেখে আশার আলোই দেখছেন সবাই। পোয়েটিক জাস্টিস পুরোপুরি না হোক, অন্তত দুর্নীতিবাজদের শাস্তি হবে, এই আশাতেই রয়েছেন সবাই।