চার মাসে ইডি-সিআইডির অভিযানে রাজ্যে উদ্ধার ৮০ কোটি! বাংলা এতই ধনী?

গত কয়েকমাসে বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতি ও টাকা উদ্ধারে শিরোনামে যাঁরা। অলঙ্করণ: সুবর্ণরেখা টিম

নিজস্ব প্রতিবেদন: রজনীকান্তের শিবাজি দ্য বস সিনেমার শেষ দিকের একটা দৃশ্য। মন্ত্রীর বাড়ির টালির চালের তলায় থরে থরে সাজানো টাকার বান্ডিল। রিলের সেই দৃশ্যায়ন যেন পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে রিয়েল। টালির চাল না হলেও নিয়মিত ব্যবধানে বাংলায় উদ্ধার হচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ঘরে বাইরে যেদিকে তাকাচ্ছি টাকা। বাড়িতে টাকা, গাড়িতে টাকা, খাটের তলায় টাকা, স্টেশনে বান্ডিল বান্ডিল টাকা। ৫০০, ২০০০-এর নোটের বান্ডিল দেখছি প্রায় রোজ। টিভি চ্যানেল খুললেই টাকার খবর। টাকার পাহাড়ে বাংলা। 

এ রাজ্য এক সঙ্গে প্রথম বিপুল অঙ্কের টাকা দেখেছিল ২০১৫ সালের আগস্টে। পেশায় হাওড়া পুরসভার সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার প্রণব অধিকারীর মালি পাঁচঘড়ার নস্করপাড়া লেনের বাড়িতে মিলেছিল গুপ্তধন। বাড়ির দেওয়ালে, মেঝেয়, সোফায় এমনকি বাথরুমে কমোডের ঢাকনাতেও মিলেছিল বান্ডিল বান্ডিল টাকা উদ্ধার হয়েছিল। গোনাগুণতি শেষে টাকার অঙ্ক দাঁড়িয়েছিল ২০ কোটিরও বেশি। মিলেছিল প্রচুর সোনার গয়না, জমি বাড়ির দলিল, ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিটের মতো বিপুল সম্পত্তির হদিশ। আবার বছর দু’য়েক আগে মধ্য কলকাতায় এক ব্যবসায়ীর বহুতল অফিসে তল্লাশি চালিয়েছিল ইডি। অভিযানের ফাঁকে সুযোগ বুঝে বাথরুমের জানালা দিয়ে টাকার বান্ডিল ফেলে দেওয়া হয়েছিল। উড়তে উড়তে সেই টাকা নীচে পড়েছিল। টাকা উড়ছে বলে গুজব ছড়িয়েছিল। তবে টাকার অঙ্কে তা ছিল চুনোপুঁটি। এ পর্যন্ত বঙ্গের জনজীবনে টাকা নিয়ে বড়চর্চায় বালির ইঞ্জিনিয়ারই ছিলেন শীর্ষে।

পার্থর বান্ধবীর ফ্ল্যাটে ২০ কোটি!

২২ জুলাই, ২০২২। এ বঙ্গে টাকা উদ্ধারের প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যায় ওই রাতে। ওই রাতে প্রায় একই সঙ্গে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে অভিযানে নামে ইডি। প্রায় ২৬ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার করা হয় পার্থ চ্ট্টোপাধ্যায়কে। কিন্তু তার চেয়েও বঙ্গবাসীর চোখ বেশি আটকে ছিল অর্পিতার ডায়মন্ড সিটির ফ্ল্যাটে উদ্ধার হওয়া টাকার খনির দিকে। তোড়া তোড়া ২০০০ ও ৫০০ টাকার নোটের বান্ডিলের ছবি ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে টিভিতে। আর গোটা রাজ্য কার্যত হাঁ করে গিলছে সেই ছবি। শেষ পর্যন্ত ইডি নিশ্চিত করে ২০ কোটিরও বেশি টাকা উদ্ধারের কথা। 

অর্পিতার বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাটেও টাকার পাহাড়!

২৮ জুলাই, ২০২২। নিয়োগ দুর্নীতিতে যখন একে একে উঠে আসছে বিস্ফোরক সব তথ্য, তারই মধ্যে আবার ইডির অভিযান। আবার টাকা। এবার অর্পিতারই বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাটে। সেখানেও খবর রটল, কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু অঙ্কটা যে অর্পিতার ডায়মন্ড সিটির ফ্ল্যাটকেও ছাপিয়ে যাবে, গোড়ার দিকে তার আন্দাজ মেলেনি। শেষ পর্যন্ত মেলে ৩০ কোটিরও বেশি টাকা। সঙ্গে সোনা, হিরের গয়না, সোনার পেন ইত্যাদি ইত্যাদি। দুই ফ্ল্যাট মিলিয়ে উদ্ধার হয় ৫০ কোটিরও বেশি টাকা।

বিধায়কদের গাড়িতে ৪৯ লাখ!

৩১ জুলাই, ২০২২। ঝাড়খণ্ডের তিন বিধায়কের গাড়ি থেকে মেলে থরে থরে সাজানো টাকাভর্তি দু’টি ব্যাগ। টাকার অঙ্ক ছিল ৪৯ লাখ। ওই তিন বিধায়ক অসম থেকে কলকাতা হয়ে রাঁচিতে ফিরছিলেন। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে হাওড়ার পাঁচলার কাছে তাঁদের আটক করে পুলিস। পুলিসের সন্দেহ, বিধায়ক কেনা-বেচার খেলাতেই ওই টাকা দেওয়া হয়েছিল বিধায়কদের। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার সঙ্গে ডিল চূড়ান্ত করে রাঁচিতে ফিরছিলেন বলেও অভিযোগ। 

পুরপ্রধানের বাড়িতে ৬০ লাখ! 

২ সেপ্টেম্বর, ২০২২। হালিশহর পুরসভার তৃণমূল পুরপ্রধান রাজু সাহানির বাড়িতে সিবিআইয়ের অভিযানে উদ্ধার হয় প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা। এছাড়াও বিদেশের একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে হদিশ মেলে কোটি কোটি টাকার। সানমার্গ চিটফান্ড মামলায় তাঁকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। 

মাছ ব্যবসায়ীর কুবেরের খাজানা!

৪ সেপ্টেম্বর ২০২২। মালদহের এক মাছ ব্যবসায়ীর বাড়িতে সিআইডির হানা। উদ্ধার হয় প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা। ওই ব্যবসায়ীর ঘর থেকে মেলে তাড়া তাড়া নোটের বান্ডিল। পরে ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে সিআইডি। অভিযোগ, মাছের ব্যবসার আড়ালে ভারত-বাংলাদেশে মাদক পাচারের কারবারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ওই ব্যবসায়ী। সেই পাচারের টাকাই উদ্ধার করে সিআইডি। 

অ্যাপ প্রতারণায় ১৭ কোটি!

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২। গার্ডেনরিচে আমির খানের বাড়ি থেকে ১৭ কোটি ৩২ লক্ষ টাকা উদ্ধার করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। তদন্তে নেমে ইডির হাতে এসেছে বিস্ফোরক তথ্য। ক্রিপ্টোকারেন্সি, বিদেশের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট মিলিয়ে ১০০ কোটিরও বেশি টাকার হদিশ মিলেছে বলে ইডি সূত্রে খবর। পরে ২৩ সেপ্টেম্বর, উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ থেকে মোবাইল গেমিং অ্যাপ প্রতারণা চক্রের মূল পাণ্ডা আমিরকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ।

লোকাল ট্রেনে ৬১ লাখ!

১১ অক্টোবর, ২০২২। এছাড়াও নৈহাটি স্টেশনে এক যুবকের ব্যাগভর্তি উদ্ধার টাকাও নজর কেড়েছে রাজ্যবাসীর। নৈহাটি স্টেশনে কল্যাণী সীমান্ত লোকাল থেকে নামতেই আটক করা হয় বছর আঠেরোর এক যুবককে। তাঁর সঙ্গে থাকা ব্যাগে তল্লাশি চালিয়ে মেলে ৬১ লক্ষ টাকা। পরে ওই যুবককে গ্রেফতার করে পুলিস। জানা যায়, ওই টাকা এক স্বর্ণব্যবসায়ীর। যদিও ওই টাকার সঙ্গে হাওয়ালা যোগ রয়েছে বলে প্রাথমিক অনুমান তদন্তকারীদের। 

পাণ্ডে ব্রাদার্সের কোটি কোটি!

১৬ অক্টোবর, ২০২২। অকুস্থল হাওড়া। এবার আসরে কলকাতা পুলিস। হাওড়ার মন্দিরতলার অপ্রকাশ মুখার্জি লেনের একটি অভিজাত আবাসনে হানা দেয়। ফ্ল্যাটের নীচে গ্যারেজে রাখা গাড়ির ডিকিতেই উদ্ধার ব্যাগভর্তি টাকা। এবার দু’কোটি ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এছাড়াও সোনা, রুপো এবং হিরের গয়নাও উদ্ধার হয় ওই ব্যাগ থেকে। জানা যায়, গাড়িটি শৈলেশ পাণ্ডের। পরের দিন শৈলেশের আরও একটি ফ্ল্যাটে হানা দিয়ে কলকাতা পুলিস উদ্ধার করে ৬ কোটিরও বেশি টাকা। দু’দিনে উদ্ধার হওয়া টাকার অঙ্ক দাঁড়ায় ৮ কোটিরও বেশি। জানা যায়, একটি ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা পর পর ট্রান্সফার হওয়ায় সন্দেহ হয় ব্যাঙ্কের। ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকেই পুলিসে খবর দেওয়া হয়। শিবপুর পুলিশের সহায়তায় অভিযানে নামে হেয়ার স্ট্রিট থানার পুলিস।

চার মাসে ৮০ কোটি!

অর্থাৎ গত চার মাসে শুধু নগদ টাকাই উদ্ধার প্রায় ৮০ কোটি। এছাড়াও যাঁরা ধরা পড়েছেন, তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এবং সম্পত্তির হিসেব যোগ করলে টাকার অঙ্ক কয়েকশো কোটি। এই বিপুল টাকা উদ্ধার দেখে কার্যত চোখ কপালে উঠেছে বঙ্গবাসীর। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রেই এমন গুপ্তধনের সন্ধান মিলেছে যে, তদন্তকারী অফিসাররাও তাজ্জব বনে গিয়েছেন। 

বাংলা কি এতই ধনী?

তবে কি বাংলা সত্যিই এতটা ধনী? এত টাকা বাঙালির ছিল, এটা বিশ্বাস করতেই যেন কষ্ট হচ্ছে। অথচ বাংলা গরিব রাজ্য। বাংলার সামগ্রিক আর্থসামাজিক চিত্র দেখেই তা বোঝা যায়। বেকারত্ব, বেরোজগারি, শিল্প-কারখানা, কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়া, জীবনযাত্রার মান-সহ আর্থিক অবস্থার প্রায় সবক’টি মাপকাঠিতেই পিছিয়ে বাংলা। অন্তত ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যগুলির তুল্যমূল্য বিচারে। করোনার সময় সেই ছবিটা আরও দাঁত নখ বের করে ফেলেছিল। এখন আবার কিছুটা চাপা দেওয়া গিয়েছে। রাজ্যে চাকরির এমন হাল যে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত পরামর্শ দিয়েছেন ‘পুজোর সময় চা-ঘুঘনি বিক্রি’র। আর সরকারি চাকরিতে নিয়োগে যে বিপুল দুর্নীতি হয়েছে, তার কোটি কোটি টাকা নিশ্চয়ই নানা হাত ঘুরে বহু জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তার হয়তো পুরো হিসেবও পাওয়া যাবে না, বা কখনওই উদ্ধারও হবে না। 

মাথাপিছু আয়ে ২১ নম্বরে পশ্চিমবঙ্গ

পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেওয়া যাক। ২০১৯-২০ সালে কেন্দ্রের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ভারতের গড় মাথাপিছু আয় বছরে এক লক্ষ ৪৭ হাজার ২১০ টাকা। অর্থাত্‍ মাসে ১২ হাজার ২৬৭ টাকার মতো। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের গড় মাথাপিছু আয় বছরে ১ লক্ষ ২১ হাজার ৪৬৩ টাকা। মাসিক ১০ হাজার ১২২ টাকার কাছাকাছি। দেশের মধ্যে মাথাপিছু আয় সবচেয়ে বেশি গোয়ার বাসিন্দাদের (মাসিক ৩৬ হাজার ৩৩০ টাকার মতো)। সবচেয়ে কম মাথাপিছু আয় বিহারের (মাসিক প্রায় তিন হাজার ৮৫৮ টাকা)। দেশের ৩৩টি রাজ্যের মধ্যে মাথাপিছু আয়ে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ২১ নম্বরে। অর্থাৎ ২০ রাজ্যের মাথাপিছু আয় পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বেশি। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের প্রকাশিত তথ্যে বাংলায় মূল্যবৃদ্ধির হার সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি (৯.৪৪%)। গ্রামীণ এলাকায় মূল্যবৃদ্ধির হার আরও ভয়ঙ্কর। ১০ শতাংশেরও বেশি। সূতরাং পশ্চিমবঙ্গ যে বড়লোক রাজ্য নয়, বরং গরিব রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম, তা পরিসংখ্যানেও স্পষ্ট। 

ধনবৈষম্য, নাকি দুর্নীতি বেড়েছে?

তাহলে এত টাকা আসছে কোথা থেকে? সমাজতত্ববিদদের ব্যাখ্যা, পশ্চিমবঙ্গ গরিব এ কথা ঠিক। কিন্তু সবাই গরিব এমন নয়। ধনসম্পদের সমবন্টনের অভাব। অর্থাৎ ধনবৈষম্যের হার অনেক বেশি। এর অর্থ, রাজ্যের বেশিরভাগ ধনসম্পদ খুব অল্প কিছু সংখ্যক মানুষের হাতে কুক্ষিগত। তাঁদের বিত্ত-বৈভবের শেষ নেই। কার্যত অফুরন্ত সম্পত্তি। খরচ করার জায়গা নেই। কোভিডের সময় সেটা খানিকটা প্রকাশ্যে এসেছিল। এই শ্রেণির বিলাসবহুল জীবনযাপনের এমনই অভ্যাস যে করোনার সময়েও গোপনে পার্টি করা, পাঁচতারা হোটেল, নাইটক্লাব, পাবে ধরা পড়েছেন অনেকে। ন্যূনতম চাহিদা মিটিয়ে লকডাউনের সঙ্গে তাঁরা মানিয়েই নিতে পারেননি। উল্টোদিকে গরিব আরও গরিব হচ্ছেন। কোভিডে কাজ হারিয়েছেন। নতুন কর্মসংস্থান নেই। রুজি-রুটির টানে পাড়ি জমাচ্ছেন ভিন রাজ্যে।

অনেকের আবার যুক্তি, এই ধনবৈষম্য অর্থাৎ গুটিকয়েক লোকের হাতে অধিকাংশ ধনসম্পদ তো আগেও ছিল। কিন্তু এমন বেআব্রু ভাবে প্রকাশ্যে এত টাকা দেখা যায়নি। এই শ্রেণির যুক্তি, এর মূল কারণ, দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি, প্রতারণা। রাজনীতির সঙ্গে দুর্নীতি কার্যত সমার্থক হয়ে উঠেছে। এমনকি, সাধারণ মানুষও কার্যত এই ধারনায় বিশ্বাসী যে, যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা তো বড়লোক হবেন, তাঁরা খানিকটা দুর্নীতি করবেন। অবশ্য সব রাজনীতিবিদকে এই গোত্রে ফেলতে নারাজ তাঁরা। এখনও অনেক সৎ রাজনীতিবিদ আছেন বলেই তাঁদের বিশ্বাস। আবার প্রযুক্তি যেমন বিপ্লব এনে দিয়েছে, প্রতারণা, জালিয়াতিতেও সেই বিপ্লব এসেছে। নানাভাবে প্রতারণা করেও টাকার পাহাড়ে চড়ে বসছেন অনেকে।