চাকরি দুর্নীতিতে গ্রেফতার, তবু চন্দন মণ্ডলের নাম ‘সৎ রঞ্জন’ কেন জানেন?

নিয়োগ দুর্নীতিতে (Recruitment Scam) গ্রেফতার সেই সৎ রঞ্জন ওরফে চন্দন মণ্ডল (Chandan Mondal)। - অলঙ্করণ: সুবর্ণরেখা টিম

নিজস্ব প্রতিবেদন: শেক্সপিয়র বনাম রবীন্দ্রনাথের ‘হোয়াটস ইন এ নেম’ বনাম ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ বিতর্ক পুরনো হলেও (Bagda) এখনও রসদ খুঁজে পান সাহিত্যরসিকরা। সেই রসদ জুগিয়ে দেন উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার চন্দন মণ্ডলের (Chandan Mondal) মতো কিছু মানুষ। চন্দন মণ্ডল মানে বাগদার চন্দন ওরফে সৎ রঞ্জন, যাঁকে নিয়োগ দুর্নীতিতে  (Recruitment Scam) যুক্ত থাকার অভিযোগে এত দিন পর গ্রেফতার করেছে সিবিআই (CBI)। 

যিনি কিনা কোটি কোটি টাকা নিয়ে দুর্নীতির বাঁকা পথে বহু মানুষকে চাকরি দিয়েছেন বলে অভিযোগ, তার নাম সৎ রঞ্জন! এমন আয়রনি! এমন ফ্যালাসি! এই আয়রনির অবশ্য একটা নেপথ্য কাহিনী রয়েছে। কেন তাঁর নাম সৎ রঞ্জন, তার একটা ব্যাখ্যা আছে। সেই প্রসঙ্গে আসার আগে এই রঞ্জনের কীর্তিকলাপের দিকে একটু চোখ বোলানো যাক। 

উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার মামাভাগিনা গ্রামে বাড়ি। নিজে পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক। গোলাপি রঙের দোতলা বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকেন। বাড়িঘর থেকে চালচলন খুব একটা বিলাসবহুল নয়। বরং সাদামাটাই বলা যায়। একটি স্কুটারে ঘুরতেন বলে শোনা যায়। হয়তো আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মতো কারও চোখে না পড়ে, সেই জন্যই এমন জীবনযাপন করতেন চন্দন। এলাকার মানুষজনও তাঁকে সৎ রঞ্জন নামেই জানে। 

যদিও অনেকেই জানেন, এই সৎ রঞ্জনের উপর মহলের অনেকের সঙ্গেই দহরম-মহরম আছে। অনেককে চাকরি করিয়ে দিয়েছেন। সেটা যে বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে, তাও অনেকেরই জানা। আর গ্রেফতার হওয়ার পর এখন এলাকায় শুধুই একটাই আলোচনা, সৎ রঞ্জন। আগে যাঁরা ভাল মানুষ বলে জানতেন, তাঁরাই এখন বলছেন, এ তো হওয়ারই ছিল। 

কীভাবে নিয়োগ দুর্নীতিতে নাম উঠল এই সৎ রঞ্জনের? পার্থ চট্টোপাধ্যায় তখনও গ্রেফতার হয়নি। মানে নিয়োগ দুর্নীতি এমন বেআব্রু ভাবে সামনে আসেনি। সামনে আসেনি এমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, সাদা ওএমআর শিট জমা দিয়েও চাকরি পাওয়ার নজির, এসব তখনও অনেক দূরে। প্রায় দু’বছর আগে প্রথম তাঁর নাম করেন উপেন বিশ্বাস। তিনিও বাগদার বাসিন্দা। প্রাক্তন সিবিআই কর্তা। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রীও বটে। সেই উপেন বিশ্বাসই বলেন, এই সৎ রঞ্জন নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িত। সরাসরিই বলেন, চাকরি দেওয়ার নামে টাকা তুলেছেন।

তার পর থেকে তাঁর নাম নিয়ে কম চর্চা হয়নি। জল গড়িয়েছে আদালতে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্য়ায়ের এজলাসে দাঁড়িয়েও উপেন বিশ্বাস বলেছেন এই চন্দন মণ্ডলের কথা। বিচারপতি তাঁকে খুঁজে বের করার নির্দেশও দিয়েছিলেন। কিন্তু সিবিআই তাঁকে খুঁজে পায়নি। অবশেষে তিনি নিজেই ভেসে ওঠেন। আত্মপ্রকাশ করে সিবিআই তলবে বেশ কয়েকবার নিজাম প্য়ালেসে হাজিরাও দেন। ফের সততার পরিচয় দেন রঞ্জন। অবশেষে তাঁকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। 

কিন্তু কেন তাঁর নাম সৎ রঞ্জন? এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, তিনি যাঁর কাছ থেকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে টাকা নিয়েছেন, তাঁর প্রায় সিংহভাগ লোককেই চাকরি দিয়েছেন। এমনই তাঁর স্ট্রাইক রেট। কিন্তু তা বলে বিরাট কোহলি হোক বা সচিন তেন্ডুলকর, সব ম্যাচেই বড় রান করবেন, এমনটা তো হতে পারে না। চন্দন মণ্ডলের ক্ষেত্রেও তেমনটা হয়েছে। কিন্তু তিনি কারো টাকা মেরে দেননি। চাকরি না হলে টাকা ফেরত দিয়েছেন। শুধু ফেরত দেওয়াই নয়, সেই টাকার সুদও দিয়েছেন। অর্থাৎ কেউ হয়তো পাঁচ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়েছেন চাকরির জন্য়। কোনও কারণে তাঁর চাকরি হল না। 

ধরা যাক দু’বছর পর টাকা ফেরত দিলেন। তখন কিন্তু পাঁচ লাখ নয়, ফেরত দিয়েছেন বাজার চলতি সুদের হারে পাঁচ লাখ টাকার সঙ্গে দু’বছরের সুদের টাকা। এই কারণেই তো তিনি সৎ রঞ্জন। একেই বলে অনেস্ট করাপশন। অক্সিমোরন হলেও প্রশাসন, রাজনীতিতে এটা প্রচলিত শব্দ। যার অর্থ, বেআইনি পথে কোনও কাজের জন্য টাকা নাও, কিন্তু সেই কাজটাও হওয়া চাই। কিন্তু টাকাও নেওয়া হল, আবার কাজও হল না, তেমন খুল্লমখুল্লা দুর্নীতি হয়তো চন্দন মণ্ডল করেননি বলেই তাঁর নাম সৎ রঞ্জন। 

এই অনেস্ট করাপশন বা সৎ দুর্নীতির অর্থ কিন্তু এই নয় যে, এই ধরনের দুর্নীতি করলে তিনি দোষী বা অপরাধী নন, বা তাঁর দুর্নীতির অভিঘাত কিছু কমে যায়। দুর্নীতি দুর্নীতিই। তার সঙ্গে সৎ অসতের কোনও সম্পর্ক নেই। আইনের চোখে সমান অপরাধ।