বোতল ভেঙে বেরিয়ে পড়ল তৃণমূলের নবীন-প্রবীণ সংঘাতের ব্রহ্মদৈত্য! শেষ কোথায়?

নবীন-প্রবীণ তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম অভিষেক সংঘাতে বেজায় অস্বস্তিতে তৃণমূল।  

নিজস্ব প্রতিবেদন: তৃণমূলে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব এবার আরও প্রকাশ্যে, আরও জোরদার। স্পষ্ট করে বললে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংঘাত আরও তীব্রতর। সরাসরিই মুখ খুলছেন তৃণমূল নেতারা, যা কার্যত জাপানের সুনামির চেয়েও দ্রুতগতিতে সঞ্চারিত হচ্ছে দলের ছোট, বড়, মাঝারি সর্বস্তরের নেতাদের মধ্যে। প্রতিষ্ঠা দিবস থেকে যে সংঘাতের ব্রহ্মদৈত্য বোতল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, সে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বঙ্গ রাজনীতিতে এবং বিশেষ করে তৃণমূলের অন্দরে। এই সংঘাতের শেষ কোথায়, পরিণতি মুলায়ম-অখিলেশের মতো হবে কিনা, কিংবা মহারাষ্ট্রে একনাথ শিন্ডের পুনরাবৃত্তি পশ্চিমবঙ্গে হবে কিনা, তা নিয়েও রাজনৈতিক মহলে তুমুল চর্চা। বিরোধীরা কটাক্ষ করে বলছেন, দলের প্রতিষ্ঠা দিবসেই তৃণমূলে বিসর্জনের বাজনা বেজে গিয়েছে।  

এমন নয় যে এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আবহ আগে সামনে আসেনি। অভিষেকের নতুন তৃণমূলের ঘোষণা এবং তা নিয়ে দলের একাংশের প্রচার, কিংবা পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে অভিষেকের নবজোয়ার যাত্রাতেও জল্পনা চরমে উঠেছিল। কিন্তু একের পর এক নেতা একে অন্যের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন, এমন বেআব্রু চেহারায় সামনে আসেনি। প্রতিষ্ঠা দিবসের দিনেই কার্যত কাদা ছোড়াছুড়ির পর্যায়ে চলে গিয়েছে সুব্রত বক্সি, ফিরহাদ হাকিম, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং  উল্টো দিকে কুণালের একা সবাইকে আক্রমণ করা নিয়ে জল গড়িয়েছে অনেক দূর। 

তর সইছে না অভিষেকের?

তৃণমূলে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের উত্তরাধিকারী যে অভিষেক, বিশেষ করে শুভেন্দু অধিকারী দল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার পর, তাতে আর কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা কবে, কখন, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, অভিষেক নিজে এবং তাঁর অনুগামীরা চান, এখনই দলের সমস্ত দায়িত্বভার ভাইপোর কাঁধে তুলে দিন পিসি। তিনি থাকুন প্রশাসনিক দায়িত্বে, অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে। আর দলের নীতি-নির্ধারণ থেকে সমস্ত বিষয় ঠিক করুন অভিষেক। অভিষেক আগেও বলেছেন, দলে বয়সের ঊর্ধ্বসীমা থাকা উচিত। সেই ইঙ্গিত যে তারই পিসির দিকে, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নিশ্চয়ই সেটা বুঝেছেন। কিন্তু যে দল তাঁর নিজের হাতে গড়া, শূন্য থেকে শুরু করে রাজ্যের ক্ষমতায় আসা, দলকে এত বড় করা - সব কিছু ছেড়ে এখনই বানপ্রস্থে চলে যাবেন, এমনটাও তিনি ভাবতে পারেন না। 

মমতার হাতেই বিষবৃক্ষ রোপন? 

প্রয়াত তৃণমূল নেতা ও মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ মহলে বলতেন, তৃণমূলের কারও ছবি যদি সংবাদপত্রে ছাপা হয়, তাহলে সেই দিনই দলে কার্যত তাঁর অবস্থা সঙ্কটময় হয়ে উঠবে। অথচ সেই মমতাই নিজের ছবির সঙ্গে গত তিন চার বছর ধরে অভিষেকের ছবি-সহ প্রচার মেনে নিয়েছেন। প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শমতো দলের অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে নবজোয়ার যাত্রা, পঞ্চায়েত ভোটে টিকিট দেওয়ার সিদ্ধান্ত-সহ আরও অনেক বিষয় অভিষেকের উপর ছেড়ে কার্যত খোলা ছুট দিয়ে রেখেছিলেন অভিষেককে। কিন্তু সেই অভিষেকই যে এত দ্রুত তাঁর ঘাড়ের উপর নি:শ্বাস ফেলবেন, সম্ভবত মমতার মতো ধুরন্ধর রাজনীতিবিদও তার আঁচ করতে পারেননি। আর যখন আন্দাজ পেয়েছেন, তখন হয়তো রাশ অনেকটাই হাতছাড়া। তবে বুঝতে পেরে খানিকটা লাগাম টানার চেষ্টা করছেন মমতা নিজেই। 

নেপথ্যে অভিষেকের সায়?

আর সেই লাগাম টানার চেষ্টা করতেই দাঁত নখ বের করে ফেলেছেন অভিষেক অনুগামীরা। সপ্তাহখানেক আগে থেকে অভিষেক শিবির থেকে জল্পনা ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চান তিনি। তবে দল বললে প্রচার বা অন্য কর্মসূচিতে যোগ দেবেন। নি:সন্দেহে অভিমানের সুর। কিন্তু অভিষেকও সেখানেই থেমে নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাকের ডগায় কুণাল ঘোষ, তাপস রায়দের মতো নিজের ঘনিষ্ঠ অনুচরদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। তার দু’দিন পরই অলআউট অ্যাটাকে কুণাল ঘোষ থেকে নবীন ব্রিগেডের নেতারা খুল্লমখুল্লা আক্রমণ শানাচ্ছেন। পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই প্রশ্ন, তবে কি অভিষেকের অঙ্গুলি হেলনেই এমন খোলামেলা আক্রমণ। 

ঘোষ বনাম বক্সি

প্রতিষ্ঠা দিবসে তৃণমূলের সদর কার্যালয়ের অনুষ্ঠানে সুব্রত বক্সি বলেন, অভিষেক পিছিয়ে আসবেন না। দলনেত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের নেতৃত্বে লড়াই করবেন। এতেই বেজায় চটে যান কুণাল। কোনও রাখঢাক না করে দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রতকে চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ শানিয়ে বলেন, অভিষেক পিছিয়ে আসবেন কেন? তিনি তো নেতৃত্বেই আছেন। নন্দীগ্রামের ভোটে কারচুপি করে শুভেন্দু জিতেছেন, এতদিন পর্যন্ত এটাই ছিল তৃণমূলের ঘোষিত লাইন। তা নিয়ে মামলাও চলছে। কিন্তু ভোটের প্রায় দু’বছর পর দলেরই রাজ্য সভাপতি তথা নন্দীগ্রামে মমতার হয়ে ভোটের দায়িত্বে থাকা সুব্রত বক্সিকে কাঠগড়ায় তুলে আক্রমণ শানিয়েছেন কুণাল। তাঁর বক্তব্য, যাঁরা নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মুখ, এত বিরাট মাপের মুখ বিক্রি করতে পারেন না, তাঁরা বড় বড় কথা বলছেন? মার্গো সাবান বিক্রি করতে এসেছেন? যদিও কুণালের বক্তব্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কার্যত পণ্যের সঙ্গে তুলনা করা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। 

কুণাল VS ফিরহাদ

আবার ফিরহাদকেও সরাসরি তুলোধনা করেছেন কুণাল। প্রতিষ্ঠা দিবসেই চেতলার অনুষ্ঠানে বেহালায় ফিরহাদ কার্যত চাকরি দুর্নীতির কথা স্বীকার করে নেন। তাঁর বক্তব্য, অস্বীকার করার উপায় নেই যে দলের একাংশ দুর্নীতি করেছেন, চাকরি বিক্রি করেছেন। টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রি আসলে মায়ের মাংস কেটে খাওয়ার সমান। ফিরহাদের উপমা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সেটা পিছনের সারিতে। এক্কেবারে সরাসরি ফিরহাদকে নিশানা করে কুণাল বলেন, তিনিও সেই কথাই এক সময় বলতে চেয়েছিলেন (পার্থ চট্টোপাধ্যায় ইস্যুতে)। কিন্তু তখন তাঁকে কটাক্ষ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি মন্ত্রিসভার কেউ নন। ফিরহাদকে কাঠগড়ায় তুলে কুণাল এও বলেছেন, জানতেন যদি, আগে আটকাননি কেন? 

কুণাল-সুদীপ চাপানউতোর

কুণালের তোপের মুখে পড়েছেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। পয়লা জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা দিবসে উত্তর কলকাতার একটি কম্বল বিতরণের অনুষ্ঠানে খানিকটা আগে-পরে যোগ দেন কুণাল এবং সুদীপ। সেখানে সুদীপের বক্তব্য ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না থাকলে বাংলা ছাগলের তিন নম্বর সন্তান হয়ে যাবে। তৃণমূল নেত্রীর জন্যই নাকি বাংলাকে চেনে গোটা ভারতবর্ষ। সুদীপের এই মন্তব্য অবশ্যই অতিকথন। বাংলার মণীষীদের অপমান করলেন কিনা, সেই প্রশ্ন উঠলেও সেটাও পিছনের সারিতে। সুদীপকে সরাসরি নিশানা করে কুণাল ঘোষের কটাক্ষ, এটা কী ধরনের কথা। দিল্লিতে গিয়ে অভিষেক যে এত বড় আন্দোলন করলেন, উনি কি সেটা জানেন না? এখন অন্ধ আনুগত্য দেখাচ্ছেন? তিনি থাকলে নাকি সুদীপকে ভাব সম্প্রসারণ শিখিয়ে দিতেন। 

মুখ খুলছেন আরও অনেকে

ভাব সম্প্রসারণ বলতে কুণাল কী বলতে চেয়েছেন, তা স্পষ্ট না হলেও নবীন-প্রবীণ সংঘাত সম্প্রসারিত হয়েই চলেছে। পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্য়ায় মঙ্গলবারও বলেছেন, দ্বন্দ্ব ছিল, আছে, থাকবে। দ্বন্দ্ব নিয়েই তিন বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। প্রবীণদের নিশানা করে অশোকনগরের বিধায়ক নারায়ণ গোস্বামীর মন্তব্য, অনেকেরই সফটওয়্যার আপডেট করতে হবে। কোচবিহারের প্রবীণ নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ আবার সরাসরি নবীন ব্রিগেডকে আক্রমণ শানিয়ে বলেছেন, নবীনরা উপযুক্ত হওয়ার আগেই হাতে দায়িত্ব ও ক্ষমতা তুলে দিলে দল শেষ হয়ে যাবে। পরিষদীয় প্রতিমন্ত্রী তাপস রায় আবার নবীন-প্রবীণ সংঘাতে ভারসাম্যের বার্তা দিতে নেত্রী-সেনাপতির তত্ত্ব আওড়েছেন। 

শেষ কোথায়? 

অর্থাৎ ওমিক্রণের চেয়েও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে দলের উপর মহল থেকে তৃণমূল স্তরে। এতদিন দলের যেসব নেতা-নেত্রীদের ভাবনায় ছিল না, তাঁরাও কোন পক্ষ নেবেন, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন এমন হল? বিরোধীরা বলছেন সেটিং। বিজেপি-তৃণমূলের সাজানো নাটক। অধীর চৌধুরী আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হলেও তিনি আশ্চর্য হবেন না। কিন্তু এই গোটা বিতর্কে এখনও পর্যন্ত চুপ মমতা এবং অভিষেক দু’জনেই। আবার প্রতিষ্ঠা দিবসের পরের দিনই অভিষেক মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের বাড়িতে গিয়ে প্রায় ঘণ্টা তিনেক ছিলেন। শেষ পর্যন্ত জল কতদূর গড়ায়, আপাতত সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন।