আবাসে দুর্নীতির বাসা! ক্ষীর খাচ্ছেন নেতারা | হুমকি, শাসানিতে আশা-হত কর্মীরা

প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় (Pradhan Mantri Awas Yojana) জেলায় জেলায় দুর্নীতির পাহাড়। অলঙ্করণ: সুবর্ণরেখা টিম
নিজস্ব প্রতিবেদন

আশা-অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার (Pradhan Mantri Awas Yojana) সমীক্ষায় নামতেই ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়ছে বেড়াল। নাম পরবর্তন করে বাংলার বাড়ি (Banglar Bari) নিয়ে তৃণমূল (TMC) - বিজেপি (BJP) এক দফা বিতর্ক হয়েছে। এবার উঠে আসছে বিস্ফোরক সব অভিযোগ। লাগামছাড়া দুর্নীতি (Corruption), স্বজনপোষণের আঁচ মিলছে জেলায় জেলায়। তার জন্য হুমকি, শাসানির মুখে পড়তে হচ্ছে আশা কর্মীদের। কাজ ছাড়তে চেয়ে বহু জায়গায় প্রশাসনের দ্বারস্থ হচ্ছেন আশা কর্মীরা। এমনকি, হুমকির জেরে উত্তর চব্বিশ পরগনার স্বরূপনগরে এক আশা কর্মী আত্মঘাতী হয়েছেন বলেও অভিযোগ।

পদ্ম শিবির এবং বিশেষ করে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির দুর্নীতি নিয়ে রাজ্যের শাসক দলকে তোপ দেগে আসছেন। তার উপর আবাস যোজনার নাম বদল নিয়েও রাজ্য রাজনীতিতে শাসক-বিরোধী চরম সংঘাতের সাক্ষী বঙ্গ রাজনীতি। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার নাম পাল্টে বাংলার আবাস যোজনা করা নিয়ে তরজা তুঙ্গে উঠেছিল। তার মধ্যেই প্রকল্পের বরাদ্দ বন্ধ করে দিতে কেন্দ্রের কাছে চিঠি লিখেছেন, দরবার করেছেন শুভেন্দু অধিকারী। কেন্দ্রও সাময়িকভাবে আবাস যোজনার টাকা বন্ধ রেখেছিল।

কত টাকা পাওয়া যায়? 

প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় সমতল এলাকায় ৭০ হাজার থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয় গরিবদের। পার্বত্য এলাকায় এই টাকার অঙ্ক ৭৫ হাজার থেকে এক লাখ ৩০ হাজার। কেন্দ্র ৬০% এবং রাজ্য ৪০% টাকা দেয়। এই টাকা দেওয়া হয় নিম্নবিত্তদের বাড়ি তৈরির জন্য। কাঁচা বাড়িতে থাকেন এমন মানুষকে। পাকা বাড়ি থাকলে এই বাড়ি প্রকল্পের সুবিধা পাওয়া যায় না। ধাপে ধাপে টাকা দেওয়া হয় উপভোক্তাকে। বাড়ি তৈরির কাজ কতটা এগিয়েছে বা সম্পূর্ণ হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা জিও ট্যাগিং প্রযুক্তির সাহায্যে।  

এই আবাস যোজনাতেই সমীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য। জেলায় জেলায় সমীক্ষার কাজ শুরু করেছেন আশা কর্মীরা। সেই সমীক্ষায় নামতেই উঠে আসছে দুর্নীতির গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ। স্বজনপোষণের পর্দাফাঁস হচ্ছে গ্রামে-গ্রামে, পঞ্চায়েতে-পঞ্চায়েতে। সেই দুর্নীতি, স্বজনপোষণের অভিযোগ সমীক্ষায় নথিবদ্ধ করতে গেলেই জুটছে শাসানি, হুঁশিয়ারি, প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত। তাতেই আশাহত আশা কর্মীরা।

দুর্নীতি-স্বজনপোষণের নানা পন্থা

কীভাবে দুর্নীতি, কেমন দুর্নীতির তথ্য পাচ্ছেন আশা কর্মীরা? সমীক্ষা সূত্রে খবর, একতলা, দোতলা বা তিনতলা পাকা বাড়ি রয়েছে এমন অনেকের নাম রয়েছে আবাস যোজনার ঘর প্রাপকদের তালিকায়। অভিযোগের তালিকায় রয়েছেন প্রধান, উপপ্রধান, পঞ্চায়েত সদস্য থেকে শাসক দলের নেতা, হাফ নেতা বা কর্মীরা। এমনকী, একই প্রকল্পে একবার ঘর পেয়েছেন, দ্বিতীয়বার আবার নাম উঠেছে, এমন নজিরও হাতের কাছে প্রচুর। 

আরও পড়ুন: কোন স্কুলের মাস্টার, কোথায় বাড়ি? ১৮৩ ঘুষের শিক্ষকের নাম প্রকাশ হতেই দিকে দিকে প্রশ্ন

দ্বিতীয় অভিযোগ স্বজনপোষণের। কখনও নিজের নামে, কখনও বা পরিবারের অন্য সদস্য, আত্মীয়দের একাধিক নাম আবাস যোজনার উপভোক্তার তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন শাসক দলের নেতা-নেত্রীরা। এমনকি, মৃতের নামেও বরাদ্দ হয়েছে ঘর। একই পরিবারের আত্মীয়স্বজন মিলিয়ে ১০ জনের নাম পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে। উল্টো দিকে প্রকৃত যাঁরা দাবিদার, যাঁদের সত্যিই কাঁচা বাড়ি, তাঁরা ঘর পাচ্ছেন না। গ্রামে গ্রামে এমন অভিযোগের বহর দেখে চোখ কপালে উঠেছে নবান্নেরও। 

পূর্ব বর্ধমানের শাঁকারি গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান জাহাঙ্গির শেখের প্রাসদোপম বাড়ি (ডান দিকে)। তবু স্ত্রীর নাম রয়েছে আবাস যোজনার তালিকায়। - নিজস্ব চিত্র

শুধু অভিযোগ নয়, প্রমাণও মিলেছে বহু। উপরের ছবিতে ডান দিকের এই প্রাসাদোপম চার তলা বাড়িটি পূর্ব বর্ধমানের শাঁকারি গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান জাহাঙ্গির শেখের। কিন্তু সদ্য প্রকাশিত আবাস যোজনার তালিকায় তাঁর স্ত্রী সীমা শেখের নাম রয়েছে। উপভোক্তার তালিকায় রয়েছে দুই ভাই আমনগির ও আজমগির শেখের নাম। এখানেই নয়, জাহাঙ্গিরের প্রয়াত বাবা সেখ মহসিনের নামও আবাস যোজনার তালিকায়। আবার এই পঞ্চায়েতেই ভাঙাচোরা বাড়িতে বসবাসকরা অনেকের নাম ওঠেনি তালিকায়। 

গ্রামে গ্রামে এমন নজির বহু। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগ শাসক দলের নেতা-জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে। হয় নিজেরা উপভোক্তার তালিকা তৈরি করেছেন, নয়তো যাঁরা তালিকা তৈরি করেছেন, তাঁদের উপর চাপ দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে নাম ঢোকানো হয়েছে। আর সেই ‘ভুয়ো’ নাম কাটতে গেলেই গোল বাধছে ব্লকে ব্লকে, পাড়ায় পাড়ায়। 

হুমকি শাসানিতে আশা-হত আশা কর্মীরা

রোষের মুখে পড়েছেন আশা কর্মীরা। এই আশা বা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা অধিকাংশই নিজের এলাকায় কাজ করেন। নেতা বা দুর্নীতিবাজরাও তাঁদের দুর্বলতা বা ক্ষমতা জানেন। সেই সুযোগ নিয়ে হুমকি, শাসানি দিচ্ছেন। ফলে তাঁরাও সব সময় সঠিক তথ্য লিখতে ভয় পাচ্ছেন। জলে থেকে কুমীরের সঙ্গে লড়াই করা যে নানা সমস্যা ডেকে আনা সেটা বুঝতে পারছেন। সেই কারণেই সমীক্ষার পরেও সব জায়গায় বাস্তব চিত্রটা সামনে আসবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। 

আরও পড়ুন: কীভাবে ধাপে ধাপে নিয়োগ দুর্নীতির নীলনকশা? চক্রব্যূহ ভেদ করতে পারবে সিবিআই ?

আশা কর্মীদের আসলে উভয়সঙ্কট। প্রশাসনের কর্তারা নির্দেশ দিচ্ছেন, চোখে যা দেখছেন, যা তথ্য পাচ্ছেন সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং সঠিক লিখতে হবে সমীক্ষায়। না হলে চাকরি সঙ্কটে পড়বে। আবার সঠিক তথ্য দিলে নেতার রোষে পড়ে সামাজিক জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা। এই দুইয়ের টানাপোড়েনে, জেলায় জেলায় আশাহত আশা কর্মীরা। জেলায় জেলায় সমীক্ষা করতে যেতে রাজি হচ্ছেন না আশা কর্মীরা। একই কারণে হয়তো আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন স্বরূপনগরের রেবা বিশ্বাস। 

নবান্ন, শাসক দল কি জানত না? 

প্রশ্ন হল, আবাস যোজনার এই লাগামহীন দুর্নীতির খবর কি রাজ্যের শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে নেই? বা সমীক্ষা শুরু হওয়ার আগে ছিল না? নবান্নেরও কি অগোচরে ছিল? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, কিছুটা নিশ্চয়ই খবর ছিল। তবে প্রায় প্রত্যেক পাড়ায়, প্রত্যেক মহল্লায় এমন বেনিয়ম, এমন দুর্নীতির খবর হয়তো ছিল না। তাই সমীক্ষায় এমন দুর্নীতির তথ্য সামনে আসতেই শুরু হয়েছে নড়াচড়া। নবান্নে এক দফা বৈঠক হয়েছে। তাতেও অবশ্য দুর্নীতি নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্চ করা হয়নি। বরং আশা কর্মীদের নিরাপত্তার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থাত্‍ পুলিসি নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কিন্তু পুলিস না হয় সমীক্ষার সময় থাকল, বাকি দিনরাত তো পাড়াতেই থাকতে হবে। বাকি ৩৬৪ দিনও থাকতে হবে। নেতাদের এই ত্রাস, চোখরাঙানি আটকাতে তাঁরা কি আর তখন থাকবেন। সেই কারণেই আশা কর্মীরা আশাহত। চোখে মুখে আতঙ্ক, ভীতির ছাপ সর্বত্র। 

ধাপে ধাপে দুর্নীতি!

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের ব্যাখ্যা, আবাস যোজনার দুর্নীতির অনেকগুলি স্তর। পেঁয়াজের মতো। প্রত্যেক খোসার পরতে পরতে দুর্নীতির আঁচ। সরকারি অর্থ নয়ছয়ের চক্র। তালিকায় বেনিয়ম বা দুর্নীতি-স্বজনপোষণ, তার একটা স্তর। স্ত্রী বা আত্মীয়দের নাম ঢোকাতে পারলেই কেল্লা ফতে। দ্বিতীয় ধাপের দুর্নীতি হল সরকারি টাকা পকেটে পোরা। এটাও তালিকার সঙ্গেই যুক্ত। তালিকায় নাম ঢুকে গেলেই টাকা পাবেন। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে ঘর তৈরি হবে না। এই পর্যায়ে দেখিয়ে দেওয়া হবে ঘর তৈরি হয়ে গিয়েছে। এর ঘাড়ে তার ঘর, তার ঘাড়ে আরেকজনের ঘরের ছবি দিয়ে গোঁজামিল করে মিলিয়ে দেওয়া হবে হিসেব। আর আবাস যোজনার পুরো টাকা পকেটে। হিউম্যান ব্রেনের সঙ্গে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (জিও ট্যাগিং) সেখানে দুগ্ধপোষ্য শিশু। 

তৃতীয় স্তরের দুর্নীতিতে অবশ্য কার্যত সমাধিস্থ হয়ে গিয়েছে। অর্থাত্‍ সেটা আর কখনও সামনে আসবে বলে মনে হয় না। সেটা হল যাঁরা ঘর পেয়েছেন, তাঁদের থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে। আপনার নিজের পাড়াতেও যাঁরা ঘর পেয়েছে, একান্তে জিজ্ঞেস করুন, সবাই বলবে কত টাকা পাওয়ার কথা, তার মধ্যে কত টাকা নেতাদের দিয়েছেন এবং কত নিজেরা পেয়েছেন। অর্থাত্‍ কাটমানি নিয়েছেন নেতা-জনপ্রতিনিধিরা। কয়েক বছর আগেও যা রাজ্য রাজনীতিতে ব্যাপক আলোড়ন ফেলেছিল। দিকে দিকে দাবি উঠেছিল কাটমানি ফেরতের। কিন্তু ঘর প্রাপকরাও সরকারি টাকা যা পেয়েছেন, তাতেই খুশি। ফলে সেই দুর্নীতির এমন দাঁত নখ বেরিয়ে আসেনি। সামগ্রিকভাবে রাজ্য জুড়ে আলোড়নও এতটা পড়েনি। 

সব প্রকল্পেই লাগামছাড়া দুর্নীতি?

এখন প্রশ্ন হল, এই দুর্নীতি কি শুধুই এই প্রকল্পে? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একটা বড় অংশের মতে, শুধু আবাস যোজনা নয়, সব সরকারি প্রকল্পেই তদন্ত হলে এমন গরমিল, বেনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপোষণের প্রমাণ মিলবে ভুরি ভুরি। লাগামছাড়া দুর্নীতি হয়েছে প্রায় সব কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের প্রকল্পে। যেমন একশো দিনের কাজে ভুয়ো জব কার্ড, পুকুর না কেটেও পুকুর খননের টাকা তুলে নেওয়া, আবার চাষের জমি ভরাটের নামে টাকা আত্মসাত্‍-এমন নজির চোখ কান খোলা রাখলেই দেখা যায় গ্রামে গঞ্জে। 

ভোটের মুখে বাড়ছে শাসকের অস্বস্তি

শিক্ষা দুর্নীতিতে এমনিতেই বেজায় অস্বস্তিতে রাজ্যের শাসক দল। গ্রেফতার হয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর দুই ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এবার আবাস যোজনার এমন দুর্নীতি সামনে চলে আসায় বেজায় অস্বস্তিতে রাজ্যের শাসক দল। বিশেষ করে পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে গ্রাম বাংলার এই দুর্নীতিতে ভোটব্যাঙ্কে ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কায় ঘাসফুল শিবির। কিন্তু সেই ইস্যুকে হাতিয়ার করে বিরোধীরা কতটা পালে হাওয়া টানতে পারবেন, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আবার গ্রাম বাংলার আম জনতারও বেশিরভাগ অংশ সুবিধাভোগী। কোনও না কোনও সরকারি প্রকল্পের টাকা পেয়েছেন বা অন্য ভাবে লাভবান হয়েছেন। আবার যাঁরা দুর্নীতিতে জড়িত, তাঁরা প্রভাবশালী। বঞ্চিতরা তুলনায় অনেক দুর্বল। ফলে দুর্নীতির প্রতিফলন ভোটবাক্সে পড়বে এমন আশা ক্ষীণ। বরং আরও সুবিধা পাওয়ার আশায় বা আরও সরকারি টাকা দুর্নীতি করে আত্মসাতের নেশায় বর্তমান শাসক দলের দিকেই ঝুঁকতে পারেন, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ।