ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধে জীবনের ময়দানে হার, প্রয়াত ফুটবল সম্রাট পেলে

প্রয়াত ফুটবল সম্রাট পেলে (Pele Death)। অলঙ্করণ: সুবর্ণরেখা টিম 

নিজস্ব প্রতিবেদন

প্রয়াত হলেন ফুটবল সম্রাট পেলে (Pele Death)। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। ব্রাজিলের (Brazil) সাও পাওলোর একটি হাসপাতালে দীর্ঘ রোগভোগের পর জীবনাবসান হয়েছে ফুটবল কিংবদন্তীর। সোশ্যাল মিডিয়া ইনস্টাগ্রামে পেলের মেয়ে এই খবর জানিয়ে লিখেছেন, আমরা যা কিছু হয়েছি, সেটা তোমার জন্য়। তোমায় সীমাহীন ভালবাসি। শান্তিতে ঘুমাও। পেলের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ ফুটবল বিশ্ব। 

দীর্ঘদিন ধরেই সঙ্কটজনক ছিলেন পেলে। কোলনের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, ক্যান্সারের সব রকম চিকিৎসা দেওয়া শেষ। আর কোনও ট্রিটমেন্ট বাকি নেই। সেটা বিশ্বকাপ চলাকালীন। তখন থেকেই বাস্তববাদী ফুটবলপ্রেমীদের একাংশের মধ্যে আশঙ্কাটা তৈরি হয়েছিল, এ যাত্রায় হয়তো আর ফিরবেন না ফুটবল সম্রাট। বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পেলের কোটি কোটি ভক্তরা অবশ্য তখনও মিরাকল-এর আশায় বুক বাঁধছিলেন। তবে গোটা বিশ্বকে কাঁদিয়ে জীবনের মাঠে হার মানলেন পেলে। 

জন্ম ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের ট্রেস কোরাসোয়েসে। বাবাও ফুটবলার ছিলেন। তবে পুরোদস্তুর পেশাদার ফুটবল ক্লাবে বা দেশের হয়ে খেলতে পারেননি। নিজের অপূর্ণ স্বপ্নই হয়তো ছেলের মধ্য়ে দিয়ে পূরণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। বাবার কাছেই পান প্রাথমিক প্রশিক্ষণ। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই ব্রাজিলের ক্লাব স্যান্টোসেস যোগ দিয়েছিলেন পেলে। পরবর্তীতে সেই ক্লাবেই খেলেছেন ১৮ বছর। ক্লাবের হয়ে প্রায় সব ট্রফি জিতেছিলেন। ওই ক্লাবে খেলার সময়ই নজরে পড়ে ব্রাজিলের ফুটবল কর্তাদের। সেখান থেকেই সুযোগ পান জাতীয় দলে এবং মাত্র ১৭ বছর বয়সেই ব্রাজিলের জার্সিতে ফুটবল বিশ্বকাপ খেলেছেন। 

পেলের অসামান্য নজির 

কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন পেলে। ১৯৫৮ সালে প্রথম বিশ্বকাপ জেতেন। ওই বিশ্বকাপে সুইডেনকে ৫-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ ঘরে তোলে ব্রাজিল। ফাইনাল ম্যাচে দু’টি গোল করেন পেলে। সেই ম্যাচের দিন পেলের বয়স ছিল ১৭ বছর ২৮৯ দিন। 

আরও পড়ুন: ‘ঠগ’ প্রধান বাছতে পঞ্চায়েত উজার হবে না তো? অভিষেকের ইস্তফার নির্দেশে ক্ষোভ দলেই!

তিন বার বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন পেলে। বিশ্বের আর কোনও ফুটবলারের এমন কৃতিত্ব নেই। ১৯৫৮, ১৯৬২ পরপর দু’বার এবং মাঝে একবার বাদ দিয়ে ১৯৭০ সালেও বিশ্বকাপ ঘরে তোলেন পেলে। ১৯৭০ সালেও ফাইনালে গোল পান তিনি। 

ফিফার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৩৬৬ ম্যাচে ১২৮১টি গোল করেছেন পেলে। তবে কয়েকটি গোল আন্তর্জাতিক ম্যাচে নয়। ফিফার অফিশিয়াল টুর্নামেন্টে ৮১২ ম্যাচে তাঁর গোলসংখ্যা ৭৫৭। নজরকাড়া স্ট্রাইকরেট। আর ব্রাজিলের জার্সিতে ৯২টি ম্যাচে ৭৭টি গোল করেছেন পেলে। 

আরও পড়ুন: আবাসে দুর্নীতির বাসা! ক্ষীর খাচ্ছেন নেতারা | সমীক্ষায় গিয়ে হুমকিতে আশা-হত কর্মীরা

আরও এক অনবদ্য রেকর্ড রয়েছে পেলের, যা এখনও পর্যন্ত অক্ষত তো বটেই, ভবিষ্যতেও কেউ ভাঙতে পারবেন কিনা সন্দেহ। বিশ্বকাপের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে হ্যাটট্রিকের রেকর্ড পেলের দখলে। ১৯৫৮ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে রেয়ছে তাঁর এই অনন্য নজির। সেই সময় তাঁর বয়স মাত্র ১৭ বছর ২৪৪ দিন। 

পেলের কলকাতা কানেকশন

ফুটবলের মক্কা কলকাতাতেও এসেছেন পেলে। ১৯৭৭-এর ২৪ সেপ্টেম্বর ইডেন গার্ডেন্সে মোহনবাগানের একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেন। কসমস ক্লাবের এশিয়া সফরের অঙ্গ হিসেবে মোহনবাগান বনাম কসমসের ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন ব্ল্যাক পার্ল। তাঁর পায়ের জাদু দেখতে ইডেনে ভেঙে পড়েছিল প্রায় গোটা কলকাতা। তবে পুরো ম্যাচে খেলতে পারেননি পেলে। কারণ ম্যাচে সেদিন তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল। ম্যাচের ফল হয়েছিল ২-২। কার্যত খেলার অযোগ্য হয়ে পড়েছিল ইডেন। তাতে কি, ফুটবল সম্রাটের সেই ম্যাচের কথা আজও গর্বভরে স্মরণ করে এই মহানগর। গৌতম সরকার, প্রদীপ চৌধুরী, কমটন দত্তরা খেলেছিলেন সেই ম্যাচে। মোহনবাগানের গোলকিপার ছিলেন শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের স্মৃতিকথায় আজও ফিরে ফিরে আসে সেই ম্যাচের কথা। 

২০১৫ সালে কলকাতায় পা পড়ে পেলের। তবে সেবার অবশ্য মাঠে নয়, গ্যালারিতেই ছিলেন ফুটবলের রাজা। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে আইএসএল-এ অ্যাটলেটিকো ডি কলকাতার সঙ্গে কেরালা ব্লাস্টার্সের ম্যাচ দেখেছিলেন পেলে। তবে জরুরি কাজ থাকায় বিরতিতে মাঠ ছাড়েন। 

মারাডোনা বনাম পেলে, কে সর্বকালের সেরা - এই বিতর্কে ফুটবল বিশ্ব কার্যত দু’ভাগ। আসলে দু’জনই নিজের সময়ে সেরা। ফুটবল বিশেষজ্ঞরা তেমনটাই মনে করেন। তাই তাঁরা তুলনা টানতেও চান না। বয়সে পেলের থেকে অনেক ছোট হলেও মারাডোনার মৃত্যু হয়েছে ২০২০-র ২৫ নভেম্বর। তার প্রায় দু’বছর পর চলে গেলেন পেলেও।

ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই লড়াই চলছিল। শেষ দিকে জনসমক্ষে আসাও কার্যত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত আর ফেরা হল না। পড়ে থাকল মুকুট সিংহাসন। চলে গেলেন ফুটবলের অবিসংবাদিত রাজা।