নিয়োগ দুর্নীতিতে (Recruitment Scam) সিবিআই (CBI)-এর হাতে গ্রেফতার তাপস মণ্ডল ও চন্দন মণ্ডল। অলঙ্করণ: সুবর্ণরেখা টিম |
নিজস্ব প্রতিবেদন: স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতিতে (Recruitment Scam) তিন দিনে সাত জনকে গ্রেফতার করল সিবিআই (CBI)। এর পর কে? এই আতঙ্কে ঘুম উডে়ছে টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়া এজেন্টদের। গ্রামে গ্রামে, ব্লকে ব্লকে যাঁরা টাকা তুলে পাঠিয়েছেন উপরতলায়, তাঁদের অনেকেই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেউ বাড়ি ছেড়েছেন, কেউ অতি সন্তর্পণে চলাফেরা করছেন। তাড়া করছে আতঙ্ক, এই বুঝি ডাক আসে নিজাম প্যালেস থেকে।
শুক্রবার সৎ রঞ্জন ওরফে বাগদান চন্দন মণ্ডল ও চার এজেন্টকে নিজাম প্যালেসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে গ্রেফতার করে সিবিআই। তদন্তে অসহযোগিতার অভিযোগে গ্রেফতার করে সিবিআই। এই সৎ রঞ্জনের কথাই বারবার বলেছেন প্রাক্তন সিবিআই কর্তা ও রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী উপেন বিশ্বাস। উপেন কথিত সেই চন্দন মণ্ডল গ্রেফতার হয়েছেন। যদিও তা নিয়ে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন, গ্রেফতারিতে এত দেরি কেন?
সেই সৎ রঞ্জনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। তার মধ্যেই রবিবার আবার গ্রেফতারি। এবার তাপস মণ্ডল। সঙ্গে নীলাদ্রি ঘোষ। অর্থাৎ তিন দিনে মোট সাত জনকে গ্রেফতার করল সিবিআই। এই সেই তাপস মণ্ডল, যাঁর কথা বারবার বলে এসেছেন কুন্তল ঘোষ। কুন্তলকে গ্রেফতার করেছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। সেই ইডি আদালতে দাবি করে, কুন্তল না থাকলে তাপস মণ্ডল হত না, তাপস না থাকলে পার্থ চট্টোপাধ্যায় হত না।
আরও পড়ুন: চাকরি দুর্নীতিতে গ্রেফতার, তবু বাগদার চন্দন মণ্ডলের নাম ‘সৎ রঞ্জন’ কেন জানেন?
অর্থাৎ নিয়োগ দুর্নীতিতে যে তাপস মণ্ডলও জড়িত, তার আঁচ মিলেছিল ইডির আইনজীবীর কথাতেই। আবার এই তাপস মণ্ডলের অভিযোগের ভিত্তিতেই গ্রেফতার হয়েছিলেন হুগলির যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষ। কুন্তলও বারবার আদালতে যাওয়া আসার পথে বারবার বলেছেন, তাপস মণ্ডলকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না। ফলে তাপস মণ্ডলের গ্রেফতারি যে সময়ের অপেক্ষা, তা কার্যত বোঝাই যাচ্ছিল। অবশেষে সেটাই হল রবিবার।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এর পর কে? এবার কি তবে এজেন্টদের দিকে তদন্তের অভিমুখ ঘোরাল সিবিআই? ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের মতে, সেই সম্ভাবনাই জোরদার হচ্ছে। সিবিআই-এর একটি সূত্রে দাবি, আগামী কয়েক দিন দেখতে থাকুন কী হয়? ওই সিবিআই আধিকারিকের কথায় ইঙ্গিত, আরও গ্রেফতারি অপেক্ষ করছে। কিন্তু কোন সূত্রে কীভাবে? তবে কি সৎ রঞ্জন এবং বাকি চার এজেন্ট আরও কারও নাম বলেছেন তদন্তকারীদের কাছে? সে সব বিষয়ে সিবিআই আধিকারিকরা কিছু বলতে চাননি।
আর এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন এজেন্টরা। যাঁরা এখনও গা ঢাকা দেননি, তাঁরা প্রকাশ্যে মনের জোর দেখালেও ভিতরে ভিতরে ভাঙতে শুরু করেছেন। অনেকেই কার্যত ধরে নিয়েছেন, জেলযাত্রা নিশ্চিত। পালিয়েও যে শেষ রক্ষা হবে না, সেটাও বুঝতে পারছেন অনেকেই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে, পাওনাদারদের চাপ। হাইকোর্টের নির্দেশে অনেকেরই চাকরি বাতিল হয়েছে। টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েও খোয়াতে হয়েছে। তাঁরা এখন এখন টাকা ফেরতের চাপ দিচ্ছেন। তাঁদের উপরেও রয়েছে এত দিনের মাইনে ফেরত দেওয়ার খাঁড়া।
অনেক প্রভাবশালী এজেন্ট অবশ্য এখনও যুক্তি দিচ্ছেন যে, চাকরি তো দিয়েছি, তার পর আদালতের নির্দেশে সেটা চলে গেলে আর আমাদের কী করার আছে। কেউ আশ্বাস দিচ্ছেন, পরে দিয়ে দেবেন বা আস্তে আস্তে শোধ করে দেবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথায় চিঁড়ে ভিজবে তো? সেই আশঙ্কা জোরদার হচ্ছে। বিশেষ করে এখনও আদালতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ভুয়ো চাকরিপ্রাপ্তরা। তাঁদের সেই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত যদি মাইনের টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ বহালই থাকে, তাহলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় তাঁরাও আর ছেড়ে কথা বলবেন না। ফলে আরও চাপে পড়বেন এই এজেন্টরা।
তাই এজেন্টদের অবস্থা এখন অনেকটা সুন্দরবনের মতো- জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ। পাওনাদের চাপ। সিবিআই-এর গ্রেফতারির আতঙ্ক। যে টাকা নিয়েছেন, সেটা তো ফেরত দিতে পারবেন না। কারণ, সেই টাকার সিংহভাগই পৌঁছে দিয়েছেন উপর মহলে। নিজেরা যে অংশ (আমাদের অন্তর্তদন্ত অনুযায়ী জেলা, এজেন্ট ভেদে ১০ থেকে ২৫ শতাংশের মধ্যে) নিয়েছেন, সেই টাকাও নানা ভাবে খরচ হয়েছে অধিকাংশটাই। অনেকে তাই ভাবছেন, এর চেয়ে সিবিআই-এর হাতে গ্রেফতারিও ভাল। না হলে চাকরি খোয়ানো এবং বেতন ফেরত দেওয়ার আশঙ্কায় ভোগা ভুয়ো শিক্ষকরা এখন খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। তাই পাল্টা প্রতিরোধে নামবেই, এমন আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
আবার আদালতে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়া সিবিআই-ও এখন নিয়োগ দুর্নীতির জাল কাটতে মরিয়া। তদন্তের গতি নিয়ে বারবার আদালতে ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে তদন্তকারী আধিকারিকদের। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় চূড়ান্ত অসন্তোষ প্রকাশ করে এমআই-ফাইভ এর প্রসঙ্গ টেনেছেন। ফলে গত তিন দিনে সাত জনের গ্রেফতারি দেখে অনেকেই মনে করছেন, এবার কি তবে নিয়োগ দুর্নীতির জাল গোটানো শুরু হচ্ছে? হিমশৈলের চূড়া থেকে ধীরে ধীরে গোড়ার দিকে এগোচ্ছে? এমন আশঙ্কা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আর সেই আশঙ্কাতেই রাতে ঘুম হচ্ছে না এজেন্টদের।