মোদীর বিরুদ্ধেও ভোটে লড়েছেন আতিক | কত ভোট পেয়েছিলেন জানেন?

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর (Narendra Modi) বিরুদ্ধে প্রার্থী হন আতিক আহমেদ (Atiq Ahmed)। 

নিজস্ব প্রতিবেদন: প্রয়াগরাজ শুটআউটে (Prayagraj Shootout) নিহত আতিক আহমেদ (Atiq Ahmed) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর (Narendra Modi) বিরুদ্ধেও ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। গ্যাংস্টার থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা আতিকের রাজনৈতিক জীবনও বেশ দীর্ঘ। নির্দল প্রার্থী হয়ে রাজনীতির ময়দানে এলেও পরে সমাজবাদী পার্টি, আপনা দল-এর টিকিটেও লড়েছেন। এমনকি, জেল থেকেও ভোটের ময়দানে নেমেছেন একাধিকবার। কখনও ভোটে জিতে সাংসদ বা বিধায়ক হয়েছেন। হেরেওছেন বহুবার। কিন্তু বাহুবলি আতিকের প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি উত্তরপ্রদেশের রাজনীতি। 

১৯৬২ সালে এলাহাবাদ বর্তমানে প্রয়াগরাজে জন্ম আতিকের। বাবা ছিলেন ঘোড়ার গাড়ি চালক। হাইস্কুলের গণ্ডি পেরোননি আতিক। স্কুল ফাইনালে ফেল করার পর রুজি-রুটির টানে অপরাধ জগতে প্রবেশ করতে শুরু করেন আতিক। প্রথম থেকে রেলের ওয়াগন থেকে কয়লা চুরিতে হাত পাকান। তার পর শুরু হয় তোলাবাজি। রেলের ছাট কিনে বাইরে বিক্রির ঠিকাদার যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ভয় দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে তোলা আদায় করতেন আতিক। তার পর নিজেই ঢুকে পড়েন ঠিকাদারিতে। এক সময় কার্যত এই ঠিকাদারি ব্যবসার বেতাজ বাদশা হয়ে ওঠেন আতিক। আর সেই সময়ই সাদামাটা গরিব পরিবারের ছেলে আতিক হয়ে ওঠেন গ্যাংস্টার আতিক। 

বুলেট থেকে ব্যালটের পথে

আতিকের জীবনের পরের অধ্যায় বুলেট থেকে ব্যালটের পথে উত্তরণের রোমহর্ষক কাহিনী। যে কাহিনীতে রয়েছে বহু রং, জয়-পরাজয়, উত্থান-পতন। আতিকের রাজনীতিতে হাতেখড়ি আটের দশকের শেষে। ১৯৮৯-এ মাত্র সাতাশ বছর বয়সেই এলাহাবাদ পশ্চিম কেন্দ্র থেকে নির্দলের প্রার্থী হয়ে ভোটে জিতে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় প্রবেশ করেন আতিক। জনপ্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতিতে সেই সূত্রপাত। তার পর আর কার্যত পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রাজনীতিত উত্থান হয়েছে উল্কার গতিতে। পর পর পাঁচ বার জিতেছেন এলাহাবাদ পশ্চিম কেন্দ্র থেকে।  

সপা থেকে আপনা দল

নির্দল প্রার্থী হিসেবে আরও দু’বার ১৯৯১ এবং ১৯৯৩-এ জিতে বিধায়ক হন আতিক। এর পর ১৯৯৬ সালে ওই কেন্দ্র থেকেই ভোটে দাঁড়ান সমাজবাদী পার্টির হয়ে। সেবারও ভোটে জিততে অসুবিধা হয়নি আতিকের। কিন্তু ১৯৯৮ সালে সপার সঙ্গে বিচ্ছেদ। তার পর যোগ দেন সোনে লাল প্যাটেলের তৈরি আপনা দল-এ। ১৯৯৩ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত আপনা দলের সভাপতি ছিলেন আতিক। 

নেহরুর কেন্দ্রেও প্রার্থী

এ হেন দাপুটে আতিককে প্রথম হারের মুখ দেখতে হয় ২০০২-এর উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটে। ওই বছর প্রতাপগড় কেন্দ্র থেকে আপনা দলের টিকিটে দাঁড়িয়ে হেরে যান আতিক। সম্ভবত এই হারের কারণেই ফের সপায় ঘর ওয়াপসি। মুলায়মের দলে ফিরে পরের বছরই ফের কামাল। এবার আর বিধানসভা নয়, ফুলপুর লোকসভা থেকে জিতে সংসদে পা রাখেন আতিক। সেই ফুলপুর, যে কেন্দ্র একসময় ছিল দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্র। এই কেন্দ্র থেকেই ভোটে লড়তেন জওহরলাল নেহরু।

 

২০০৯-এ আপনা দলের টিকিটে প্রতাপগড় কেন্দ্র থেকে এবং ২০১৪-র লোকসভা ভোটে শ্রবস্তী কেন্দ্র থেকে সমাজবাদী পার্টির টিকিট পেলেও সংসদের দরজা আর খোলেনি। এর পর ২০১৮-সালে আবার ফিরে আসেন ফুলপুর কেন্দ্রে। ফুলপুর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে ফের নির্দলের হয়ে লড়াই করেন। কিন্তু জিততে পারেননি।

মোদীর বিরুদ্ধে প্রার্থী

এর পর আর ছোটখোটো নয়, প্রতিপক্ষ এবার সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বারানসী কেন্দ্রে প্রার্থী হন নরেন্দ্র মোদী। সেখান থেকে জিতেই তিনি প্রধানমন্ত্রী। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সপার শালিনী যাদব। আর প্রতিদ্বন্দ্বীদের তালিকায় ছিলেন আতিক আহমেদও। নির্দল প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়ান আতিক। পেয়েছিলেন মাত্র ৮৫৫ ভোট। জেল থেকেই ভোটে লড়েছিলেন। প্রচারের জন্য প্যারোলের আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে প্রচারের সুযোগ পাননি। 

লখনউ গেস্ট হাউস কাণ্ডে শিরোনামে

ভোটে জিতুন বা হারুন, উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে বারবার শিরোনামে উঠে এসেছেন আতিক। ১৯৯৫ সালের সেই ঐতিহাসিক লখনউ গেস্ট হাউস কাণ্ডে অন্য়তম অভিযুক্ত ছিলেন তিনি। বিএসপি-র কাঁসিরাম এবং তাঁর উত্তরাধিকার মায়াবতীর সমর্থনে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে ছিলেন সপা সুপ্রিমো মুলায়ম সিং যাদব। সেই সময় জল্পনা ছড়ায় যে সপা সরকার থেকে সমর্থন তুলে নিতে পারে বিএসপি। লখনউয়ের একটি গেস্ট হাউসে মায়বতী-সহ দলের সিংহভাগ বিধায়ক ওই গেস্ট হাউসে ওঠেন। সেই গেস্ট হাউসেই তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ ওঠে সপার নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, হামলাকারীদের সামনের সারিতে ছিলেন আতিক। 

জেল থেকেই প্রার্থী, জামিনে প্রচার

আবার ২০১২ সালে জেল থেকেই ভোটে দাঁড়ান আতিক। জেলের বাইরে বেরিয়ে প্রচারের জন্য এলাহাবাদ হাইকোর্টে আবেদন জানান আতিক। কিন্তু ১০ জন বিচারপতি তাঁর আবেদন শুনতেই রাজি হননি। এক এক বিচারপতির এজলাসে গিয়েছে, আর তাঁরা নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত ১১ তম বিচারপতি মামলা শুনতে রাজি হন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে প্রচারের জন্য জেল থেকে বাইরে বেরনোর অনুমতিও দেন ওই বিচারপতি। যদিও ভোটে জিততে পারেননি আতিক। 

টুকলি কাণ্ডে গ্রেফতার

উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে কান পাতলে শোনা যায়, ব্যালটের রাজনীতিতে থাকলেও বুলেট ছাড়েননি আতিক। নিজে সরাসরি মাঠে না নামলেও তাঁর গ্যাং সব সময়ই সক্রিয় ছিল। তোলাবাজি, খুন, অপহরণ, লুটের মতো অপরাধ এবং রাজনীতিতে একের পর এক দল বদলে ভাগ্য পরীক্ষাও করে চলেছেন আতিক। শেষ বার শিরোনামে আসেন ২০১৬-র ডিসেম্বরে। ১৪ ডিসেম্বর এসএইচইউএটিএস কৃষি বিশ্ববিজদ্যালয়ের অধ্যাপক ও শিক্ষাকর্মীদের পেটানোর অভিযোগ ওঠে আতিকের বিরুদ্ধে। দুই পড়ুয়ার টুকলি করা ধরে ফেলাতেই এভাবে পেটান বলে অভিযোগ। ওই মামলায় ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ওই মামলার কেস ডায়েরি চেয়ে পাঠায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট। একই সঙ্গে পুলিস সুপারকে সব অপরাধীকে গ্রেফতারির নির্দেশ দেন বিচারপতি। পরের দিনই আতিককে গ্রেফতার করে পুলিস। 

বারবার জেলে গেলেও সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরার কসুর কখনওই ছাড়েননি আতিক। বাহুবলি ইমেজ বরাবরই ছিল। তার সঙ্গে রাজনীতির মেলবন্ধনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অবিসংবাদী ডন। কিন্তু রাজনীতিতে যত হারের মুখ দেখেছেন, ততই কমেছে দাপট। তবু নির্দলের হয়ে কিংবা জেল থেকেও ভোটে দাঁড়িয়েছেন কয়েকবার। হয়তো ভাবতেন রাজনীতির ছত্রছায়ায় থেকে অপরাধের অন্ধকার জগৎকে ঢেকে রাখতে পারবেন। সেই কারণেই হয়তো বারবার চেষ্টা করেছেন রাজনীতিতে ফিরতে। কিন্তু সফল হননি। কিন্তু শনিবারের নাটকীয় শুটআউটে নিহত হওয়ার পর আর সেই চেষ্টা করারও উপায় রইল না গ্যাংস্টার থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা আতিকের।