কার্নিভাল লোকারণ্য! ভাঁড়ে মা ভবানি অবস্থায় এই মহা ধুমধাম কি প্রয়োজন ছিল?

দু'বছর পর ফিরল পুজো কার্নিভাল (Durga Puja Carnival-2022)। রাজ্যের এমন আর্থিক পরিস্থিতির মধ্যেও কার্নিভাল নিয়ে প্রশ্ন। - নিজস্ব চিত্র
হরিদাস পাল
দু’বছর পর স্বমহিমায় ফিরল পুজো কার্নিভাল (Durga Puja Carnival 2022)। শহরের শ’খানেক পুজো কমিটির প্রতিমা, থিম নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। নাচা-গানা। একের পর এক পুজো কমিটি এসেছে, তাঁদের প্রতিমা, থিম নিয়ে। মূল মঞ্চের সামনে নাচ গান। মঞ্চ আলো করে থাকা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Benerjee)-সহ অতিথিরা বাহবা দিচ্ছেন। আর গোটা উত্স বের মধ্যমণি মুখ্যমন্ত্রী। কখনও তাঁর কাঁধে ঢাক, কখনও হাতে কাঁসর। কখনও আবার আদিবাসীদের সঙ্গে নাচের তালে পা মিলিয়েছেন। কার্নিভালের এমনই মহিমা। 

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাজ্যের কোষাগারের (State Treasury) এমন হাঁড়ির হাল, তার মধ্যেও এত মহা ধুমধাম করে কার্নিভাল করার কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল? হিন্দু-মুসলিমের সংকীর্ণ ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে কি এই প্রশ্ন করা কি যুক্তিযুক্ত নয়? কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না বলে প্রায় প্রতিদিন তোপ দাগছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের ঘাড়ে বিপুল অঙ্কের ঋণের বোঝা। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস (TMC) ক্ষমতায় আসার সময়ে রাজ্যের ঋণের পরিমাণ ছিল, ২ লক্ষ ৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালে সেই ঋণের পরিমাণ ছাড়িয়ে গিয়েছে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা। তার মধ্যে চলছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্য সাথী, সবুজ সাথী, শ্মশানবন্ধুর মতো দান-খয়রাতির প্রকল্প। অর্থনীতিবিদদের একাংশের অভিযোগ, মেলা-খেলা-উৎসব এবং ডোল বিলির একের পর এক কর্মসূচির ফলে খরচ বেড়েই চলেছে। যা সামাল দিতে ধারের উপর ধারই এখন সরকারি নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন ভাঁড়ে মা ভবানি অবস্থার মধ্যে সরকারি টাকায় এই কার্নিভালের যৌক্তিকতা কতটা, এমন প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।

রাজ্যের এই সামগ্রিক আর্থিক পরিস্থিতির পাশাপাশি সাময়িক চিত্রটাও খুব একটা সুখকর নয়। মালবাজারে বিসর্জনের ঘাটে আট জনের প্রাণ গিয়েছে। তার শোক এখনও ভুলতে পারেনি রাজ্যবাসী। রাস্তায় বসে সাড়ে পাঁচশো দিনের বেশি আন্দোলনে চাকরিপ্রার্থীরা। সেই চাকরিপ্রার্থীদেরই তুলে দেওয়া হয়েছে কার্নিভালের জন্য। নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ রাজ্যের শাসক দল। উদ্ধার হয়েছে কোটি কোটি টাকা। সেই টাকা আম চাকরিপ্রার্থীদের লুঠের টাকা বলেই মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ। উত্সবের আলোর রোশনাই আর তারস্বরে মাইক বাজিয়ে সব কিছু ঢেকে দেওয়ার প্রচেষ্টাতেই কি এত জাঁকজমক, এত জৌলুস, প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। 

 

আরও পড়ুন: বছর ঘুরলেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। ভোটে ছাপ ফেলবে এই পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি?

কার্নিভালের আগেও এক আরেক কার্নিভাল ইতিমধ্যেই দেখেছে মহানগর কলকাতা তথা রাজ্যবাসী। ইউনেস্কোর হেরিটেজ (UNESCO Heritage) স্বীকৃতির অনুষ্ঠানেও আড়ম্বড়ের খামতি ছিল না। বিপুল অর্থ খরচে হয়েছে শোভাযাত্রা, মিছিল। অনেকেরই মতামত ছিল, দুই অনুষ্ঠানকে এক সঙ্গে জুড়ে দিলে খরচে অনেকটাই লাগাম পরানো যেত। একই উপলক্ষ্যে দু’বার খরচের প্রয়োজন পড়ত না। এই অস্টারিটি মেজার বা ব্যয়সংকোচনের এমন কৌশলী পথে হাঁটতেই পারত রাজ্য। 

পুজো অনুদান নিয়েও প্রশ্ন

পুজো কমিটিগুলিকে অনুদান নিয়েও উঠেছিল বহু প্রশ্ন। কোভিডের ধাক্কায় সারা বিশ্বের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে এ রাজ্যের অর্থনীতিও। আবার মাথায় ঋণের বোঝা নিয়েও পুজো কমিটিগুলিকে এ বছর ফের অনুদানের ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুদান ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। পুজোয় পুরোপুরি কর ছাড়ের ঘোষণা আগেই হয়েছিল। এছাড়া বিদ্যুত্‍ বিলে ৬০ শতাংশ ছাড়-সহ একাধিক ছাড়ের ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। যাতে সব মিলিয়ে রাজ্যের নগদ খরচ প্রায় ২৪০ কোটি টাকা। বিভিন্ন ছাড়ের জন্য রাজকোষের লোকসানের বহরও অনেক। অর্থাত্‍ এই সব ছাড় না দিলে রাজকোষে অর্থ আসত।

কার্নিভালে অংশ নেওয়া একটি ক্লাবের ট্যাবলো। - নিজস্ব চিত্র 
রাজ্যের শাসক দলের একাংশের যুক্তি, দু’বছর কোভিডের জন্য কার্নিভাল হয়নি। তার উপর ইউনেস্কোর ইনট্যানজিবল স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলার দুর্গাপুজো। দুইয়ের যোগফলেই এমন আয়োজন। সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন ওঠে, কোভিডের আগে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি ছিল না। তখনও কি আতিশয্য বা  জাঁকজমক কিছু কম ছিল? তখনও কি এই কার্নিভালের মহা ধুমধাম দেখেনি রাজ্যবাসী? 

সরকারি টাকায় মোচ্ছব, তোপ বিরোধীদের

এই নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। নিশানায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি টাকায় মোচ্ছব বলে কটাক্ষ করেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। সুর মিলিয়ে বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালের তোপ,  "প্রদীপের নীচেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে কার্নিভাল হচ্ছে। কিন্তু সেই রাস্তার পাশেই হবু শিক্ষক-শিক্ষিকারা বসে আছেন ন্যায্য দাবিতে। কেন আপনি সমস্যার সমাধান করছেন না? কেন আপনি কার্নিভালে ফূর্তি করে বেড়াচ্ছেন?" সরকারি অর্থে এই কার্নিভালের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বামেরাও। সিপিএম নেতা রবীন দেব বলেছেন, "এত মৃত্যু হচ্ছে, সেখানে এই কার্নিভাল করছেন। এসবের কোনও অর্থ নেই।"

প্রতিবাদী কবীর সুমন

শুধু বিরোধীরা নয়, দাবি উঠেছে খোদ শাসক দলের অন্দরেও। প্রকাশ্যে অবশ্য কেউ বিরূপ মন্তব্য করেননি। তবে মুখ খুলেছেন একদা মমতা ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এবং প্রাক্তন সাংসদ কবীর সুমন। আর্জি জানিয়েছিলেন কার্নিভাল বাতিল করার। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে তাঁর আর্জি ছিল, আমি তোমার বিরোধী নই। ... আমার একটি অনুরোধ, মালবাজারে আমাদের সহ-নাগরিকদের যে আকস্মিক প্রাণহানি ঘটল, তা মনে রেখে দয়া করে আজকের কার্নিভাল বাতিল করে দাও। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তোমার কোনটা করণীয়, কোনটা করণীয় নয়, তা বলে দেওয়ার আমি কে? তিয়াত্তরে চলতে থাকা তোমার এক সহ নাগরিক হিসেবে আমি তোমায় অনুরোধ করতে পারি মাত্র।"

দুর্নীতি ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা?

কিন্তু কবীর সুমনের অনুরোধ কানে তোলেননি মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্য সরকার। তোলার প্রশ্নও নেই। কারণ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের ব্যাখা, দুর্নীতির ইস্যুতে অনকেটাই ব্যাকফুটে তৃণমূল কংগ্রেস। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির প্যান্ডোরার বাক্স খুলে গিয়েছে। চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন, একের পর এক হাইকোর্টের নির্দেশ-পর্যবেক্ষণ, সিবিআই-ইডির তদন্ত, কোটি কোটি নগদ টাকা উদ্ধার, নেতা-মন্ত্রীদের গ্রেফতারিতে বেজায় অস্বস্তিতে রাজ্যের শাসক দল। এটা যে শুধুমাত্র ব্যক্তিবিশেষের দুর্নীতি নয়, বরং গোটা দল এবং সরকার দুর্নীতির আখড়া - এমন ভাবনা জোরদার হচ্ছে। দল এবং সরকারের ভাবমূর্তি ইতিমধ্যেই বেশ খানিকটা কালিমালিপ্ত। তৃণমূলের বিরুদ্ধে জনমানসে জমছে ক্ষোভ-উষ্মা। জোরদার হচ্ছে অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি বা সরকার বিরোধী হাওয়া। সেই সব ভুলিয়ে দিতে উত্সংবের মরসুমকেই মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নিয়েছে শাসক দল। রাজ্যবাসীও এই সময় উত্সেবের আবহে গা ভাসিয়ে দেন। রাজনীতি, দুর্নীতি এ সবে খুব একটা গা করেন না। রাজ্যের শাসক দলের এমন মনোভাব যেন, দুর্গাপুজোর পর লক্ষ্মীপুজো এবং কালীপুজোর পর্যন্ত মানুষকে উত্সাবের আনন্দে ভাসিয়ে রাখ। তার পর আবার সব ভুলে যাবে মানুষ। তখন নতুন করে শুরু করা যাবে। আর তার মধ্যে নতুন কোনও ইস্যু হাতে চলে এলে আরও পিছনের সারিতে ঠেলে দেওয়া যাবে দুর্নীতির ইস্যু। এই কার্নিভাল সেই লক্ষ্যে অনেকটাই সফল বলেই মত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একটা বড় অংশের। 

আরও পড়ুন: হরিয়ানায় শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে ১০ বছর জেল খেটেছেন মুখ্যমন্ত্রী চৌটালা। বাংলার শিক্ষা কেলেঙ্কারির সঙ্গে বহু মিল

তৃণমূল বা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানেন, পুজো বা উত্স ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গেলে কিছুটা হলেও আটকাবে পদ্ম শিবিরের। উগ্র হিন্দুত্বের রাজনীতিই যাঁদের ভোটব্যাঙ্কের অন্যতম হাতিয়ার, তাঁরা পুজো বা হিন্দুধর্মভিত্তিক উত্স ব নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। একুশের ভোটের আগে অমিত শাহরা আক্রমণ শানিয়েছিলেন, রাজ্যে পুজোপাঠে বাধা দিচ্ছে তৃণমূল সরকার। তা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাঝেমধ্যেই পাল্টা তোপ দাগেন গেরুয়া শিবিরকে। ফলে বিজেপি এই উত্সমব নিয়ে প্রশ্ন তুললে পাল্টা আক্রমণ করতেও সুবিধা হবে শাসক দলের। রাজনৈতিক মহলের একাংশের ব্যাখ্যা, এই দিক থেকে দেখলে, খানিকটা হলেও সুকৌশলে উত্স।বকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। 

শেষ রক্ষা হবে?

কিন্তু শেষ রক্ষা হবে কি? গোটা বাংলা উত্সরবের আবহে ঢুকে পড়েছে বটে। কিন্তু বছর ঘুরলেই পঞ্চায়েত ভোট। প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে রাজ্যের শাসক দল। বসে নেই বিরোধীরাও। ধীরে ধীরে ভোটের হাওয়ায় তপ্ত হচ্ছে বঙ্গ রাজনীতি। বিরোধীরাও উত্সবের মরসুম শেষের অপেক্ষায়। তার পরেই ফের দুর্নীতির ইস্যুকে খুঁচিয়ে তুলতে চলছে ঘুঁটি সাজানো। ভোট পর্যন্ত সেই ইস্যু জিইয়ে রাখতে কোমর বাঁধছে বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস-সব দলই। যদিও তার ফল ভোটবাক্সে পড়বে কিনা, তার উত্তর আপাতত সময়ের গর্ভে।