দুর্নীতির ভাঁটার টানে অভিষেকের যাত্রায় তৃণমুলে ‘নবজোয়ার’ আসবে তো?

তৃণমূলে (TMC) নবজোয়ার কর্মসূচিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhiehsk Benerjee)। 

নিজস্ব প্রতিবেদন: তৃণমূলে (TMC) নবজোয়ার। জন সংযোগ যাত্রা। পঞ্চায়েত ভোটে (Panchayat Election 2023) প্রার্থী বাছাইয়ে ‘গণভোট’। নাম যাই হোক, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Abhishek Banerjee) কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ যাত্রায় কি শাসকের বিরুদ্ধে সব হাওয়া বদল হবে? পাশাপাশি একাধিক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে রাজ্যের শাসক দলের এই কর্মসূচি। দুর্নীতি, সরকারবিরোধী হাওয়া থেকে নজর ঘোরাতেই কি শাসক দল হয়েও বিরোধীদের মতো এমন কর্মসূচির প্রয়োজন পড়ল? এটা কি ক্ষমতার উত্তরাধিকার হস্তান্তরের প্রক্রিয়া? বিপুল কর্মযজ্ঞের মধ্যে দিয়েই কি শুরু হয়ে গেল অভিষেকের অভিষেক-এর সোপান? 

কর্মসূচির নাম তৃণমূলে নবজোয়ার। পুরো মাস্টারপ্ল্যান তৃণমূলের পরামর্শদাতা সংস্থা আইপ্যাক এবং প্রশান্ত কিশোরের মস্তিষ্কপ্রসূত। কোচবিহার জেলা থেকে শুরু হয়েছে অভিষেকের ‘যাত্রা’। এক একটি জেলায় ২-৩ দিন করে থাকবেন। একাধিক বিধানসভা এলাকায় দু’-তিনটি সভা। সেই সভা থেকে একদিকে তৃণমূল সরকারের জনমুখী কর্মসূচির প্রচার চলছে। তার চেয়েও বেশি চলছে বিরোধীদের তুলোধনা। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বকেয়া না দেওয়ায় গলার শিরা ফুলিয়ে আক্রমণ। দু’মাস ধরে এই ঢক্কানিনাদ শুনতে-দেখতে হবে বঙ্গবাসীকে।

বিলাসবহুল যান, থাকার বন্দোবস্ত নিয়ে প্রশ্ন

কিন্তু অভিষেক যাচ্ছেন বা থাকছেন কীভাবে? সেও এক বিলাসবহুল ব্যাপার। যে ক্যারাভানে অভিষেক যাচ্ছেন, সেটা কার্যত লাক্সারি ভ্যান। আরাম আয়েশের যাবতীয় ব্যবস্থা রয়েছে। যে তাঁবুগুলি তৈরি হচ্ছে থাকার জন্য, সেগুলিও সাদামাটা নয়। আবার শুধু অভিষেকের জন্য নয়, মেজো, ছোটখাটো নেতাদের জন্যও তৈরি হচ্ছে একাধিক তাঁবু। রাহুল যদি সারা ভারতে পদযাত্রা করতে পারেন, অভিষেক কি শুধু বাংলার জন্য তেমন যাত্রা করতে পারতেন না? রাহুলের পদযাত্রা নিয়েও যে প্রশ্ন নেই, তেমন নয়। রাহুল বা কংগ্রেসের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল ঠিকই, কিন্তু তাতে অনেকটা আন্তরিকতা ছিল বলেই মনে হয়েছে দেশবাসীর। তাতে কংগ্রেস কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে বা পারবে কিনা, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। অভেষেকও তেমন কিছু করলে বরং অনেক বিশ্বাসযোগ্য হত।

জননেতা হওয়ার চেষ্টা? 

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আক্ষরিক অর্থেই জননেত্রী। অনায়াস ও সাবলীল ভঙ্গিতেই মিশে যেতে পারেন সাধারণের ভিড়ে। তাঁদের দু:খ কষ্টের সমব্যথী হয়ে উঠতে পারেন তাঁদের মতো করে। অর্থাৎ তৃণমূল নেত্রীকে কার্যত নিজের মেয়ে, দিদি, বা মায়ের মতো মনে করেন রাজ্যের প্রান্তিক মানুষের একটা বড় অংশ। কিন্তু অভিষেক সেখানে যুবরাজ বা রাজপুত্র। ধরা ছোঁয়ার বাইরে। জনতার ভিড়ে মিশে গেলেও তাঁর সঙ্গে যে নিরাপত্তার ঘেরাটোপ, যে বলয় থাকে, তাতে অনেকেই আমজনতার একজন বলে ভাবতে পারেন না। হাতের নাগালে পেলেও সব অভাব অভিযোগ জানাতে বাধো বাধো লাগে। 

ধরা যাক, এক জন দরিদ্র মানুষ লটারি জিতলেন। এক রাত তিনি পাঁচতারা হোটেলে কাটাতে পারবেন বিনা পয়সায়। তো সেই লোকটি পাঁচতারা হোটেলে গিয়ে যেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারবেন না, এটা অনেকটা সেই রকম। অভিষেকের সেই ‘রাজপুত্র’ ইমেজ ঝেড়ে ফেলে ‘জননেতা’ বা মাঠে ঘাটের লোক হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা এই কর্মসূচির অন্যতম উদ্দেশ্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু যেভাবে তাঁর যাত্রার রুটম্যাপ ছকা হয়েছে এবং যে বহরে বন্দোবস্ত করা হয়েছে, তাতে সেটা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। 

কেন্দ্রের কাছে প্রাপ্য বকেয়ার আবেগে শান

কেন্দ্র প্রাপ্য বকেয়া দিচ্ছে না বলে প্রায় প্রত্যেক সভা থেকে বলে আক্রমণ শানিয়ে কার্যত গলায় রক্ত উঠে যাওয়ার জোগাড়। একশো দিনের কাজ করেও টাকা পাচ্ছেন না যাঁরা, আবাস যোজনার কিস্তির টাকা পেয়ে অর্ধেক ঘর করে আর এগোতে পারছেন না, বা তালিকায় নাম ওঠার পরও টাকা পাচ্ছেন না যাঁরা, গ্রামগঞ্জের সেই হতদরিদ্র মানুষের ভাবাবেগকে কাজে লাগাতে চাইছে তৃণমূল। আর সেই আবেগে শান দিয়ে এই একশো দিনের কাজ এবং আবাস যোজনায় যে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, সেটাকে পিছনের সারিতে ঠেলে দিতে চাইছেন অভিষেক। কী বলছেন অভিষেক? বলছেন, দুর্নীতি হলে তাঁদের ধরে জেরে ভরুন, কিন্তু প্রকৃত হকদারদের টাকা আটকে রেখে ভাতে মারবেন না। 

এখন প্রশ্ন হল, তৃণমূলের যে নেটওয়ার্ক, তাতে এই দুর্নীতি ধরা তাদের খুব বেশি হলে এক মাসের ব্যাপার। তাঁদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? কে কত টাকার দুর্নীতি করেছেন, তার হিসেব কষতেও তো তেমন কাঠখড় পোড়াতে হবে না। নথি ঘাঁটলেও পাওয়া যাবে। সেই দুর্নীতির টাকা পার্টি ফান্ডে দিলে রাজকোষে ফিরিয়ে দিন, আর নিজে কুক্ষিগত করলে তাঁদের থেকে নিয়ে রাজকোষে ফেরান। সেই সৎসাহস নিশ্চয়ই দেখাতে পারবে না তৃণমূল, কারণ, তাতে ঠগ বাছতে গাঁ উজার হওয়ার জোগাড় হবে। 

এর নাম নাকি গণভোট

অভিষেকের ঘোষণা, সাধারণ মানুষই নাকি নিজেদের পঞ্চায়েতের প্রার্থী ঠিক করবেন। তার জন্য নেওয়া হচ্ছে ‘গণভোট’। গণভোট হল হ্যাঁ বা না-তে ভোট দিয়ে কোনও ব্যক্তি বা কোনও সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে মত নেওয়ার প্রক্রিয়া। তাতে সাধারণ মানুষ ভোট দেন। এই ভোটের নাম যে কেন গণভোট দেওয়া হল, তা বোধগম্য হয় না। এই ভোটে কি একজনও অন্য দলের মানুষ ভোট দিতে যাবেন? দলের নেতাদের মধ্য়েই সিতাই, সাহেবগঞ্জে যে কুরুক্ষেত্র বেধেছে, রক্তারক্তি কাণ্ডে মাথাভাঙায় আক্ষরিক অর্থেই মাথা ভেঙেছে, তাতে আর কোনও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সাধারণ মানুষ ভোট দিতে যাবেন, এমনটা আশা করা যায় না। তবু তার নাম গণভোট। কারণ তৃণমূল নাম দিয়েছে তাই। 

দুর্নীতি থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা?

পরের প্রশ্ন দুর্নীতি। মহাকাব্যিক পর্যায়ে চলে গিয়েছে নিয়োগ দুর্নীত। মাঝেমধ্যেই গ্রেফতার হচ্ছেন শাসক দলের নেতা-বিধায়ক-মন্ত্রী। উঠে আসছে নতুন নতুন বিস্ফোরক সব তথ্য। কয়লা, গরু পাচারেও নাকানি-চোবানি খেতে হচ্ছে। অনুব্রত মণ্ডল ও তাঁর কন্যার সম্পত্তি দেখে চোখ কপালে উঠেছে আম জনতার। বিরোধীদের নিত্যনতুন তিরে বিদ্ধ হতে হচ্ছে শাসক দলকে। জনমানসেও এমন একটা ধারণা কার্যত তৈরি হয়েছে যে, তৃণমূলের নেতা মানেই দুর্নীতিবাজ। হয়তো সবাই এমনটা নন, কিন্তু যে কয়েকজন ধরা পড়েছেন এবং কার্যত প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে তাঁদের দুর্নীতি, তাঁদের বিপুল বিত্ত-বৈভব, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বহর দেখে বাকিদের ক্ষেত্রেও কার্যত এমন ধারনা বদ্ধমূল হতে বসেছে। ফলে বাসে-ট্রেনে, চায়ের আড্ডায় এবং সর্বোপরি সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রায় সর্বত্র এক চর্চা। সেই চর্চা থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টায় যে এমন কর্মসূচি, তা তৃণমূলের অনেক নেতাও ঘনিষ্ঠ মহলে বলাবলি করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, নজর ঘোরানো যাবে তো? শিক্ষা থেকে পুরসভায় নিয়োগ, একশো দিনের কাজ, আবাস যোজনায় যে ভাবে পাড়ায় পাড়ায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তার থেকে নজর ঘুরিয়ে শুধু কেন্দ্রীয় বঞ্চনার ধুয়ো তুলে দুর্নীতির অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়া যাবে তো? 

মহড়াতেই রক্তারক্তি, আসল ভোটে কি হবে? 

এবার প্রার্থী বাছাইয়ের প্রসঙ্গ। অভিষেক বলে বেড়াচ্ছেন, তৃণমূলের নেতারা নাকি ৯৯.৯ শতাংশই সৎ। কেশপুরে তো মঞ্চে তুলে উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন। যদিও পুরো ব্যাপারটাই যে আগে থেকে তৈরি করা স্ক্রিপ্ট, ওই বিশাল ব্যানার দেখানোর পর তা বুঝতে আর কারও বাকি নেই। যাই হোক, যে ০.১ শতাংশ অসৎ বা দুর্নীতিগ্রস্ত, তাঁদের ছেঁকে বের করে পঞ্চায়েতে ১০০ শতাংশ সৎ প্রার্থী দেওয়াৎ নাকি লক্ষ্য়। এবং সেই প্রার্থীও নাকি ঠিক করবেন সাধারণ মানুষ। যদিও তৃণমূল কর্মীর বদলে সুকৌশলে সাধারণ মানুষ বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলের মধ্যেই প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে যে মারকাটারি পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, তার পর সাধারণ নির্বিরোধী মানুষ ওই ভোটাভুটির ধারেকাছে ঘেঁষবেন, এমন আশা করাও বৃথা। অনেকেই বলছেন, মহড়া অর্থাৎ মক পোলেই যদি এই হয়, আসল ব্যালট নিয়ে কী হতে পারে, তার পূর্বাভাস দিয়ে গেল সিতাই, সাহেবগঞ্জ আর মাথাভাঙা। 

আর কতবার শান্তিপূর্ণ ভোটের আশ্বাস

শান্তিপূর্ণ ভোটের আশ্বাস। এই নিয়ে কত বার আশ্বাস দিলেন অভিষেক, এবং কত বার তার ব্যতিক্রম হল, তা গুণতে গিয়ে অনেকেই খেই হারাচ্ছেন। কলকাতা পুরসভা, তার পর ১০৮ পুরসভা। প্রশ্ন হচ্ছে, যা তিনি বলেন, তার মধ্যে কি সত্যিই ততটা আন্তরিকতা আছে? আবার অভিষেক বললেই যে গ্রাম-গ্রামান্তরের নেতা-কর্মীরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সুবোধ বালক হয়ে যাবেন, তা ভাবলে মুর্খের স্বর্গে বাস করবেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। কারণ, একবার পঞ্চায়েত সদস্য হতে পারলে পাঁচ বছরে কত যে আয়ের রাস্তা খুলে যাবে, তার বিকল্প কি অভিষেক দিতে পারবেন? কেন্দ্র, রাজ্যের কত কত প্রকল্প গ্রামে। একশো দিন আর আবাস যোজনা সবার পরিচিত। বাকি যে আরও এমন বহু প্রকল্প আছে, যা হয়তো অনেকে জানেনও না। আর প্রকল্প মানেই জনতার কাজ। জনতার মধ্যে তো পঞ্চায়েত সদস্য নিজেও একজন। সূতরাং তাঁর নিজের কাজও হবে। এই আর কি। তাই তো পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থী হতে এমন লঙ্কাকাণ্ড।