‘অ্যাক্ট অব ফ্রড’ বললেন না! কাঁদলেন প্রধানমন্ত্রী! মরবি ব্রিজ বিপর্যয়ে নীরব কেন মোদী?

গুজরাতে মরবি ব্রিজ (Gujarat Morbi Bridge Collapse) ভেঙে পড়া কাণ্ডে রাজনৈতিক চাপানউতোর তুঙ্গে। - অলঙ্করণ: সুবর্ণরেখা টিম

নিজস্ব প্রতিবেদন: ১৯৮২। ফকল্যান্ড যুদ্ধ। ইংল্যান্ডের সঙ্গে আর্জেন্টিনার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে হারতে হয়েছিল আর্জেন্টিনাকে।

চার বছর পর। ১৯৮৬ সাল। মেক্সিকোয় বসেছে ফুটবল বিশ্বকাপের আসর। কার্যত একা দলকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার কিংবদন্তী ফুটবলার দিয়েগো মারাদোনা। ওই বিশ্বকাপেই দু’টি প্রায় অত্যাশ্চার্য ঘটনা ঘটেছিল। সেমিফাইনালে মুখোমুখি আর্জেন্টিনা ও ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডের ডি বক্সে মাথার উপরের বল লাফিয়ে উঠে‘হেডে’ গোল করেছিলেন মারাদোনা। কিন্তু পরে টিভি রিপ্লেতে ধরা পড়ে হেড নয়, হাত দিয়ে গোল করেছিলেন মারাদোনা। মাঠের কোনও রেফারিও ধরতে পারেননি। ব্রিটিশ ফুটবলাররা হ্যান্ডবলের দাবি করলেও শোনেননি রেফারি। পরে মারাদোনাও স্বীকার করে বলেছিলেন, ফকল্যান্ড যুদ্ধের প্রতিশোধ নিতে ওটা ছিল ‘হ্যান্ড অব গড’। 

গুজরাতে মোরবি ব্রিজ ভেঙে পড়ার (Gujarat Morbi Bridge Collapse) সঙ্গে মারাদোনার এই হ্যান্ড অব গডের যোগসূত্র কোথায়? কেনই বা প্রায় চার দশক পর এই ঘটনার অবতারণা? সরাসরি যোগসূত্র না থাকলেও মোরবি দুর্ঘটনার পরেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে চলে এসেছে এই ‘হ্যান্ড অব গড’ চর্চা। একটু অন্যভাবে। কিন্তু চর্চা চলছে। 

মোরবিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্রিজ দুর্ঘটনা। সারা বিশ্বে বহু ব্রিজ ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু একসঙ্গে এত মানুষের মৃত্যুর নজির নেই। গুজরাতের মোরবিতে মাচ্ছু নদীর উপর ঝুলন্ত ব্রিজের কেবল ছিঁড়ে পুরো ব্রিজ চলে যায় নদীগর্ভে। জলে ডুবে, ভেঙে পড়ার শকে, আতঙ্কে মৃত্যু হয় দেড় শতাধিক মানুষের। এত বড় বিপর্যয়ের দায় কার? পুলিস-প্রশাসন, নির্মাণ সংস্থা নাকি রাজনীতি? 

আরও পডু়ৃন: ৭ নভেম্বরের পর চাকরিটা থাকবে তো! আতঙ্কে ঘুম উড়েছে ঘুষের শিক্ষকদের

সবচেয়ে বেশি চর্চা এই তৃতীয় বিষয় নিয়েই। কেন্দ্র ও গুজরাতের সরকারকে নিশানা করছে বিরোধীরা। ভোটের কথা মাথায় রেখে তড়িঘড়ি ব্রিজ উদ্বোধন করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি, ব্রিজের ফিটনেস সার্টিফিকেট নেওয়ার অপেক্ষা পর্যন্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ বিরোধী কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি-সহ অধিকাংশ বিরোধী দলের। উঠেছে কাটমানি খাওয়ার অভিযোগও। এ রাজ্যের শাসক দল এবং কেন্দ্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম বরোধী দল তৃণমূল টেনে এনেছে এই হ্যান্ড অব গড প্রসঙ্গ। কীভাবে? 

অ্যাক্ট অব ফ্রড বলেছিলেন মোদী!

২০১৬ সাল। রাজ্যে বিধানসভা ভোটের দামামা বেজে গিয়েছে। তার মধ্যেই দিনেদুপুরে ভেঙে পড়ল নর্মীয়মান পোস্তা উড়ালপুল। মৃত্যু হয় ২৬ জনের। আহত হন আরও প্রায় ২০০ মানুষ। সেই সময়ই রাজ্যে ভোট প্রচারে এসে রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে নিশানা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (PM Narendra Modi) টেনে এনেছিলেন এই হ্যান্ড অব গড প্রসঙ্গ। বলেছিলেন, ব্রিজ ভেঙে পড়ার ঘটনা ‘অ্যাক্ট অব গড নয়, অ্যাক্ট অব ফ্রড’। অর্থাত্‍ তৃণমূল তথা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ইঙ্গিত করেছিলেন মোদী। নিশনায় ছিলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। এবার মোদীর সেই বক্তব্যের ভিডিও-সহ টুইট করেছেন একাধিক তৃণমূল নেতা। তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়, সুস্মিতা দেবরা টুইটারে ওই বক্তব্যের অংশ দিয়ে টুইট করে খোঁচা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। 

কাঁদলেন মোদী!

আর গুজরাত ব্রিজ ভেঙে পড়ার পর প্রধানমন্ত্রী কী করলেন? গুজরাত মোদীর রাজ্য। দীর্ঘদিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। গুজরাতে ক্ষমতাতেও তাঁর দল বিজেপি। দুর্ঘটনার দিন রবিবার গুজরাতেই ছিলেন মোদী। প্রশাসনিক আধিকারিকদের কাছে খোঁজখবর নিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ক্ষতিপূরণও ঘোষণা করলেন। কিন্তু গেলেন না ঘটনাস্থলে। এমনকি, পরের দিন সোমবারও গুজরাতে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিলেন। এত বড় বিপর্যয়ের পরেও বাতিল করলেন না তাঁর কর্মসূচি। ঘটনাস্থলে যান মঙ্গলবার। 

আরও পড়ুন: চার মাসে ইডি-সিআইডির অভিযানে রাজ্যে উদ্ধার ৮০ কোটি! বাংলা কি সত্যি এতই ধনী?

গুজরাতেরই বনসকান্থায় একটি কর্মসূচিতে গিয়ে মোরবি বিপর্যয়ের কথা বলতে আবেগতাড়িত হলেন। কথা বলতে গিয়ে বুঁজে এল গলা। বেশ খানিক্ষণের ‘পজ’ নিয়ে তারপর আবার কথা বললেন। চোখে নাকি অনেকে জলও দেখতে পেয়েছেন। কুম্ভিরাশ্রু কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। 

পোস্তার মৃতরাও দেশের নাগরিক

কুম্ভীরাশ্রু হয়তো বাড়াবাড়ি। একে নিজের রাজ্য। তার উপর এত বড় বিপর্যয়। দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যুতে সত্যি সত্যি হয়তো প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বিরোধীরা এবং বিশেষ করে তৃণমূল চেপে ধরেছে পোস্তা ব্রিজ নিয়ে মোদীর ওই মন্তব্যকে হাতিয়ার করে। মোদীর সেই ভাষণের  দলের নেতাদের প্রশ্ন, তবে বাংলার মানুষের জন্য মোদীর মন কাঁদে না। নিজের রাজ্য গুজরাত বলেই কি তাঁর এমন কষ্ট, দুঃখ পাওয়া। কিন্তু তিনি তো দেশের প্রধানমন্ত্রী। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নন। তাঁর মন তো সারা দেশের জন্যই কাঁদা উচিত। তাহলে পোস্তা ব্রিজের মৃত ২৬ জন এবং আহত দুই শতাধিক মানুষ কি তাঁর দেশের নাগরিক নন? তাঁদের জন্য কি তাঁর মন কাঁদেনি? 

সমবেদনা কুড়নোর চেষ্টা?

পোস্তা দুর্ঘটনা নিয়ে তৃণমূল সরকারকে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। অথচ গুজরাতের মোরবি বিপর্যয় নিয়ে কার্যত স্পিকটি নট। বিরোধীদের অভিযোগ, গুজরাতের ক্ষমতাসীন তাঁরই দল বিজেপি বা গুজরাত রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলবেন না এটা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশাসনের বিরুদ্ধেও কোনও কড়া বার্তা দেবেন না? তদন্তের নির্দেশ বা কারও দোষ প্রমাণ হলে কড়া শাস্তি পেতে হবে- এমন কোনও কথা পর্যন্ত বললেন না। বরং মৃতদের জন্য কান্নাভেজা গলায় ভাষণ দিয়ে হাওয়া নিজের দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করলেন বলে অভিযোগ বিরোধীদের। 

রাহুল কি সন্ন্যাসী রাজা!

দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের কী বক্তব্য়? কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী ভারত জোড়ো যাত্রায় হেঁটেই চলেছেন। তার ফাঁকেই রবিবার টুইট করে বলেন, গুজরাতের মোরবিতে ব্রিজ দুর্ঘটনা অত্যন্ত মর্মন্তুদ। এই কঠিন সময়ে মৃতদের পরিবারকে গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। কংগ্রেস কর্মীদের কাছে আর্জি, আহতদের সব রকম সাহায্য করুন এবং উদ্ধারকাজেও সাহায্য করুন। পরের দিন সোমবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি রাহুল। তিনি বলেন, মোরবি ব্রিজ দুর্ঘটনা নিয়ে কোনও মন্তব্য করবেন না। কারণ, মন্তব্য করলে রাজনীতি করার অভিযোগ উঠবে এবং মৃত ও আহতদের অসম্মান করা হবে। হয়তো মহান হতে চেয়েছেন বা উদারতা দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু ভোটের মুখে রাজ্যের শাসক দলকে ল্যাজে গোবরে করার মতো এমন লোপ্পা বল পেয়েও ডাক করলেন কংগ্রেস সাংসদ? গেরুয়া শিবির এমন মোক্ষম সুযোগ পেলে গেরুয়া শিবির যে তুলে তুলে বল মাঠের বাইরে পাঠাত, এমনকি এই প্রধানমন্ত্রীও তখন যে ছেড়ে কথা বলতেন না (পোস্তা ব্রিজের দুর্ঘটনা নিয়ে মন্তব্যেই তার প্রমাণ), সেই রাজনৈতিক সত্যটা রাহুল গান্ধী আর কবে বুঝবেন কে জানে?

ব্রিজ বিপর্যয়ে প্রশ্ন অনেক

অথচ মোরবি ম্যাসাকার নিয়ে প্রশ্ন অনেক। ব্রিজ দুর্ঘটনার পরেই কাঠগড়ায় গুজরাতের পুলিস-প্রশাসন। শতাব্দীপ্রাচীন ব্রিজ পুনর্নির্মাণের পর সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় ২৬ অক্টোবর। অভিযোগ, তার পর থেকে ব্রিজের উপর পুলিস-প্রশাসনের বা নির্মাণকারী সংস্থার কোনও নজরদারিই ছিল না। অর্থাত্‍ কার্যত ভগবানের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ প্রতিদিন ভিড় বাড়ছিল উত্সুক জনতা ও পর্যটকদের। তার উপর দুর্ঘটনার দিন রবিবার ছিল ছট পুজো। সেই উপলক্ষে বহু মানুষ জমায়েত হন ব্রিজের উপর। দুর্ঘটনার সময়েও প্রায় ৫০০ মানুষ ছিলেন বলে গুজরাত প্রশাসন সূত্রে খবর। অথচ সেই ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা বা সুশৃঙ্খল ভাবে ব্রিজে ওঠার ব্যবস্থ করার মতো কোনও প্রশাসনিক তত্পরতা ছিল না। আবার ব্রিজের উপরে ভিড়ের মধ্যে কোনও অঘটন, ইভটিজিং-এর মতো ঘটনাও ঘটতে পারত। অথচ ব্রিজের উপরেও পুলিস-প্রশাসনের কোনও নজরদারি চোখে পড়েনি। কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল যুবক ব্রিজে উঠে ঝাকাচ্ছেন, দোলাচ্ছেন, সাইড-রেলিংয়ে লাথি মারছেন, এমন ছবিও ধরা পড়েছে। তাদের বাধা দেওয়া বা নিষেধ করার মতোও যে কেউ ছিল না, তার প্রমাণ মিলেছে ছবিতে। 

ভোটের জন্য তড়িঘড়ি উদ্বোধন?

কিন্তু তার চেয়েও বড় অভিযোগ রাজনীতি করার। গুজরাত এবং হিমাচলে একইসঙ্গে ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হবে বলে মনে করছিলেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। কিন্তু হিমাচলে ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা হলেও গুজরাতে হয়নি। তখন থেকেই বিরোধীরা সরব ছিলেন, গুজরাতে বেশ কিছু প্রকল্পের ঘোষণা, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন বা উদ্বোধন হয়নি বলেই মোদীর রাজ্যে এখনও ভোট ঘোষণা হয়নি। ব্রিজ ভেঙে পড়ার পর বিরোধীদের অভিযোগ, ভোটের জন্যই আগুপিছু কোনওকিছু না ভেবে, সব দিক আঁটোসাঁটো না করে ভোটের জন্যই তড়িঘড়ি উদ্বোধন করে দেওয়া হয়েছে ব্রিজের। এমনকি, ফিটনেস সার্টিফিকেটের অপেক্ষা পর্যন্ত করা হয়নি। এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনতার দায়িত্ব কে নেবে?