উদোর দুর্নীতি বুধোর ঘাড়ে! নেতাদের আবাস তালিকার দায় বিডিওর? মন্ত্রী-বাক্যে ক্ষোভ

আবাস যোজনায় (Pradhan Mantri Awas Yojana) নেতারা ভুল তালিকা তৈরি করলেও দায় নিতে হবে বিডিওদের, পঞ্চায়েত মন্ত্রীর মন্তব্যে কি ক্ষোভ বাড়ছে প্রশাসনে? অলঙ্করণ: সুবর্ণরেখা টিম 
 নিজস্ব প্রতিবেদন

প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় (Pradhan Mantri Awas Yojana) লাগামহীন দুর্নীতি। প্রকৃত হকদার পাচ্ছেন না। তালিকায় নাম শাসক দল তৃণমূলের (TMC) নেতা-কর্মীদের। তাঁদের কারও পাকা বাড়ি। কারও পরিবারের একাধিক সদস্যের নাম। কারও আবার মৃত আত্মীয়ের নামেও আবাস যোজনার ঘর বরাদ্দের হদিশ মিলেছে। সমীক্ষা করতে গিয়ে কার্যত কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আসছে অজগর। সব ঘর কার্যত গিলে খেয়েছেন নেতা, কর্মী, ঘনিষ্ঠরা। এই দুর্নীতি আর স্বজনপোষণে ভরা তালিকার দায় কার? মন্ত্রী বলছেন বিডিওদের। সত্যি কি তাই? 

আবাস যোজনায় কতটা দুর্নীতি হয়েছে তার ইঙ্গিত এসে পৌঁছেছে নবান্নেও। রাজ্যের প্রশাসনিক সদর কার্যালয় সূত্রে খবর, আশা-অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা যে সমীক্ষা করছেন, তাতে তালিকা থেকে প্রায় ৫০ শতাংশ নামা কাটা যেতে পারে। তাতেও পুরোপুরি নির্ভূল করা যাবে কিনা সন্দেহ। একটা উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হবে। মুর্শিদাবাদের নওদা ব্লকের রায়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধানের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ। আবাস যোজনার ঘর প্রাপকদের তালিকায় তাঁর আত্মীয় ও পরিবারের সদস্য মিলিয়ে ১৮ জনের নাম রয়েছে বলে অভিযোগ। জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে এমন অভিযোগ ভুরি ভুরি। দুর্নীতির কাঁটা বিঁধেছে পদ্মের গায়েও। খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের বাবার নাম রয়েছে তালিকায়। আবার বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের বিজেপি বিধায়কের স্ত্রীর নামও তালিকায় ঢুকেছে।

অভিযোগ জানাতে অবশ্য ব্লকে ব্লকে ড্রপ বক্স করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নবান্ন। অর্থাত্‍ বিডিও অফিসে একটি অভিযোগ জানানোর বাক্স থাকবে লেটার বক্সের মতো। তাতে অভিযোগ জানাতে পারবেন যে কেউ। অভিযোগ এলে ১২ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার। এমন ড্রপ বক্স বা অভিযোগ বাক্স প্রায় সব সরকারি অফিসে এমনিতেই থাকে। সেই বাক্স নিয়মিত খোলা হয়, অভিযোগ বা নালিশ পড়ে দেখা হয় এবং ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এমন কথা বুক ঠুকে বলতে পারার মতো প্রশাসনিক আধিকারিক দূরবীন দিয়ে খুঁজে দেখতে হবে। 

কিন্তু গ্রামে গ্রামে গরিব-নিম্নবিত্তদের এই ঘরের টাকা আত্মসাতের দুর্নীতির দায় কার? শাসক দল, নাকি প্রশাসন? পঞ্চায়েত মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার দায় ঠেলে দিয়েছেন প্রশাসনের উপর। আরও স্পষ্ট করে বললে বিডিওদের উপর। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, আবাস যোজনার তালিকায় ভুয়ো নাম থাকলে তার জন্য নেতারা নন, দায়ী থাকবেন বিডিওরা। আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা রিপোর্ট দিলে সেই রিপোর্ট যাচাই করে দেখবেন বিডিওরা। রাজনৈতিক চাপে তালিকা তৈরি হলেও দায় নিতে হবে বিডিও-দেরই। 

পঞ্চায়েত মন্ত্রীর কথাতেই স্পষ্ট ইঙ্গিত, শাসক দলের নেতা-কর্মীরা প্রভাব খাটিয়ে তালিকায় নিজের পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়দের নাম ঢুকিয়েছেন অথবা একবার ঘর পাওয়ার পর দ্বিতীয়বার নাম তুলে দিয়েছেন। মন্ত্রী নিজেই রাজনৈতিক চাপে তালিকা তৈরির কথা বলছেন। আবার সেই রাজনৈতিক চাপের জন্য নেতাদের কোনও দায় নেই, দায় সরকারি আধিকারিকদের। তবে কি বিডিওদের ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হল নাম কাটার? পর্যবেক্ষকদের অবশ্য মত, তেমন একটা দেখানোর চেষ্টা হলেও বাস্তব পরিস্থিতিটা তা নয়। আশা-অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সমীক্ষা অনুযায়ী বিডিওরা তালিকা থেকে নাম কাটতে গেলেও আসবে রাজনৈতিক চাপ। আসতে পারে হুমকি-শাসানিও। 

প্রশাসনের নীচু স্তরে ক্ষোভ!

কিন্তু মন্ত্রীর বক্তব্যের পরেই গোল বেধেছে প্রশাসনের নীচু স্তরে। বাড়ছে ক্ষোভ। অনেকেই ঘনিষ্ঠ মহলে বলছেন, নেতারা চাপ দিয়ে, প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের মতো করে তালিকা তৈরি করেছেন। এখন আশা কর্মীদের সমীক্ষায় না নামালে হয়তো ধরাও পড়ত না। আবাসের টাকা ঢুকে যেত নেতাদের পকেটে। এখন ভুরি ভুরি দুর্নীতি-স্বজনপোষণ বেরোতেই দায় বিডিও-দের? এ তো উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে। তাই ক্ষুব্ধ বিডিও-সহ প্রশাসনের একাংশ। 

রাজ্যের বিরোধী দলগুলি প্রশাসনকে বরাবর ‘দলদাস’ বলে আক্রমণ করে। অর্থাত্‍ প্রশাসনের আধিকারিকরা শাসক দলের নেতাদের নির্দেশে, পরামর্শে বা তাঁদের কথামতো কাজ করেন। অতীতে বাম জমানায় এই অভিযোগ ছিল। অভিযোগ তুলতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল। সেই তৃণমূলই এখন সাড়ে এগারো বছর ক্ষমতায়। অথচ বাম জমানার সেই অভিযোগ থেকে মুক্ত হতে পারেনি তৃণমূলও। বরং তৃণমূলের জমানায় সেই অভিযোগ আরও জোরালো। 

আরও পড়ুন: আবাসে দুর্নীতির বাসা! ক্ষীর খাচ্ছেন নেতারা | হুমকি-শাসানিতে আশা-হত কর্মীরা

এমনকি, সম্প্রতি নদিয়ার প্রশাসনিক বৈঠকে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে বিধায়ক অভিযোগ করেছেন যে বিডিও তাঁর কথা শোনেন না। মুখ্যমন্ত্রী একটু বকেছেন বিধায়ককে। বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, বিডিও তাঁর কথা শুনে কেন শুনবেন। একই সঙ্গে তাঁর ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা, প্রকাশ্যে এসব বলার কথা নয়। অথচ ওই বিধায়ককে কড়া ভাবে কিছু বলেননি মুখ্যমন্ত্রী। একটু বকলেও আদতে যে বিধায়কের অভিযোগে কিঞ্চিত্‍ প্রশ্রয় রয়েছে, সেটাও খানিকটা বোঝা গিয়েছে। যদিও প্রকাশ্যে বিধায়কের অভিযোগকে পাত্তা দেননি। 

স্থানীয় স্তরে বর্তমান শাসক দলের নেতা-নেত্রীদের বিরোধিতা করে চাকরি করা যে কতটা কঠিন, প্রশাসনিক আধিকারিকরা তা ভাল করেই জানেন। তাই বিডিও থেকে নীচুতলার সরকারি কর্মীদের একটা বড় অংশই শাসক দলের নেতাদের অঙ্গুলি হেলনে কাজ করেন। যাঁরা কিছুটা প্রতিবাদের চেষ্টা করেন, তাঁদের উপর নেমে আসে ‘শাস্তি’র খাঁড়া। প্রত্যন্ত এলাকায় বদলি, কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল করা - ইত্যাদি ইত্যাদি। 

আবাস যোজনার দুর্নীতির দায় পঞ্চায়েত মন্ত্রী বিডিওদের ঘাড়ে ঠেলে দেওয়ার পর থেকেই প্রশাসনিক মহলে বাড়ছে ক্ষোভের বাতাবরণ। এতদিন যাঁরা নেতাদের কথামতো কাজ করে গিয়েছেন বিনা বাক্যব্যায়ে, অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতি, বেনিয়ম জেনেও সই করেছেন ফাইলে, তাঁরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন যে, বিপাকে পড়লে সেই নেতাদের পাশে পাবেন না। তাঁরা গা বাঁচিয়ে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু ফাঁসবেন সেই সরকারি আধিকারিকরাই।

নেতাদের সমস্যা নেই, ফাঁসবেন আধিকারিকরা?

আবার নেতাদের গায়ে কালির দাগ পড়লেও সমস্যা নেই। কোনও অভিযোগ বা দুর্নীতি প্রমাণ হলে জেল-জরিমানার বিধান আছে। কিন্তু সেই আইনি লড়াই সুদীর্ঘ। দীর্ঘ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া পেরিয়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেল হলে তারপর ছ’বছরের জন্য ভোটে দাঁড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে তদন্ত ও বিচার শেষে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাস্তি ঘোষণা হয় জীবনের শেষ প্রান্তে এসে। তার আগে পর্যন্ত দল বদলে হোক, বা নিজের দলে থেকেও ভোটে দাঁড়াতে কোনও সমস্যা নেই। 

আরও পড়ুন: কোন স্কুলের মাস্টার, কোথায় বাড়ি? ১৮৩ ঘুষের শিক্ষকের নাম প্রকাশ হতেই দিকে দিকে প্রশ্ন

কিন্তু সরকারি কর্মীদের চাকরি জীবনে লাল কালির দাগ পড়ার অর্থ, তাঁর কেরিয়ারে নানা জটিলতা, নানা সমস্যা। সাসপেনশন থেকে চাকরি পর্যন্ত খোয়া যেতে পারে। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর সমস্যা হতে পারে পেনশনের ক্ষেত্রেও। ফলে তাঁদের সমস্যা শাঁখের করাতের মতো। নেতাদের কথা না শুনলে কার্যত কাজ করা কঠিন। আবার শুনলে অনেক দুর্নীতি, বেনিময়ের সাক্ষী থাকতে হবে বা সরকারি সিলমোহর দিতে হবে। সেই দুর্নীতি-বেনিয়ম ধরা পড়লে আর রক্ষে নেই। চাকরি তো থাকবেই না, জেলের ঘানিও টানতে হতে পারে। দেশে এবং রাজ্যে আইপিএস, আইএএস বা ডব্লিউবিসিএস অফিসারদের জেল জরিমানার এমন নজিরও প্রচুর।

ভোটে ব্যুমেরাং হবে না তো?

পঞ্চায়েত ভোটের ডঙ্কা বেজে গিয়েছে। এই বিডিও থেকে শুরু করে ব্লক স্তরের প্রশাসনিক কর্মী-আধিকারিকরাই কিন্তু ভোট পরিচালনার মূল দায়িত্বে থাকবেন। ময়দানে নেমে কাজ করবেন তাঁরাই। শাসক দলকেও তাঁদের দিয়েই ভোট উতরাতে হবে। এমন সন্ধিক্ষণে এই নীচুতলার প্রশাসনিক কর্মীদের চটিয়ে সেই কাজ হাসিল করতে পারবে তো তৃণমূল? নাকি উপরে ধমক, ভিতরে ভিতরে প্রশ্রয় দিয়ে সুষ্ঠুভাবেই অপারেশন চালিয়ে নিয়ে যাবে? 

শুধু কি আবাস যোজনা? একশো দিনের কাজ, স্বচ্ছ ভারত বা নির্মল বাংলা-র মতো প্রায় সব সরকারি প্রকল্পেই এমন নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ। লক্ষ লক্ষ ভুয়ো জব কার্ড দেখিয়ে তাঁদের টাকা শাসক দলের নেতাদের পকেটে ঢোকানোর অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছে পদ্ম শিবির। পুকুর বা খাল কাটা ও সংস্কার, রাস্তা সংস্কারের নাম করে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে একশো দিনের প্রকল্পে। শেষ পর্যন্ত শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে কি? এই পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির ছাপ কি পঞ্চায়েত ভোটে পড়বে? এক দিকে যখন এই দুর্নীতি ছাপ ফেলার প্রবল সম্ভাবনা দেখছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা, উল্টো দিকে রয়েছে তৃণমূল সরকারের জনমুখী প্রকল্প। স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, সবুজ সাথী, শ্মশান বন্ধুর মতো গরিবদরদী প্রকল্পের ডিভিডেন্ড একুশের বিধানসভা ভোটে পেয়েছে তৃণমূল। তবে একটাই পার্থক্য, স্কুলে নিয়োগ, আবাস যোজনা, একশো দিনের কাজের মতো সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি বিধানসভার ভোটের আগে এমন নগ্নভাবে সামনে আসেনি। ফলে পঞ্চায়েত ভোটে লড়াই হতে পারে দুর্নীতি বনাম জনমুখী প্রকল্পের। সেই সংঘাতে কার পাল্লা ভারী, তার উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক মাস।