‘বেলাইন’ বন্দে ভারত, ফের মমতার সামনে জয় শ্রীরাম! মুখ পুড়ল কার?

বন্দে ভারতের (Vande Bharat) সূচনা অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) সামনে জয় শ্রীরাম (Jai Sree Ram) স্লোগান। অলঙ্করণ: সুবর্ণরেখা টিম

নিজস্ব প্রতিবেদন

বন্দে ভারতের (Vande Bharat) সূচনা ছন্দহীন হল জয় শ্রীরাম (Jai Shree Ram) ধ্বনিতে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) সামনে ফের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুষ্ঠানে জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে বিতর্ক। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পুনরাবৃত্তি হাওড়া স্টেশনে। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চেই উঠলেন না। পরিবর্তে পাশে প্ল্যাটফর্মে রাখা চেয়ারে বসলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখান থেকেই দেখলেন অনুষ্ঠান, বক্তব্য রাখলেন এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সবুজ পতাকা নেড়ে সূচনা করলেন হাওড়া-নিউ জলপাইগুড়ি বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের। 

কিন্তু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পর ফের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুষ্ঠানে এভাবে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে জয় শ্রীরাম স্লোগান ওঠায় বিতর্ক আরও জোরদার। প্রশ্ন একাধিক। প্রথমত সরকারি অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক স্লোগান দেওয়া কি যুক্তিযুক্ত। পূর্বপরিকল্পিত  এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলে তা অবশ্যই নিন্দার যোগ্য। বিজেপি নেতা-কর্মীরা দিলে তা আরও নিন্দনীয়। আবার জনতার মধ্যে থেকে স্বতঃস্ফূর্ত হলে আগে থেকে আয়োজক রেল কর্তৃপক্ষ কেন আরও সতর্ক হয়নি, সেই প্রশ্ন উঠবেই। তার দায় এড়াতে পারে না রেল। পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর মতো ভিভিআইপি অতিথিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁর সামনে এমন রাজনৈতিক স্লোগান দেওয়া কোন শিষ্টারচারের নজির? পদ্ম শিবিরের অবশ্য পাল্টা যুক্তি, ওই স্লোগান স্বতস্ফূর্ত ছিল। তাদের পাল্টা প্রশ্ন, জয় শ্রীরামের মধ্যে অন্যায় কি আছে? মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে উঠতেই পারতেন। যদিও বিজেপি নেতাদেরও একাংশের বক্তব্য, এই ধরনের অনুষ্ঠানে জয় শ্রীরাম স্লোগান না দেওয়াই কাম্য। 

হাওড়া স্টেশন থেকে সূচনা বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের। পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি। আমন্ত্রিত মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী সশরীরে থাকার কথা থাকলেও আচমকা মাতৃবিয়োগের জন্য সেই অনুষ্ঠান হয় ভার্চুয়ালি। মুখ্যমন্ত্রী নির্ধারিত সময়ে হাওড়া স্টেশন পৌঁছে যান। আগে থেকেই সেখানে ছিলেন দিলীপ ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদার, কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুভাষ সরকার-সহ রাজ্যের এক ঝাঁক বিজেপি নেতা-নেত্রী। ছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও। প্ল্যাটফর্ম পৌঁছে মমতা মঞ্চের দিকে যেতেই জনতার মধ্যে থেকে জয় শ্রীরাম স্লোগান ওঠে। 

বোঝানোর চেষ্টা রেলমন্ত্রীর 

স্লোগান শুনে তিনি যে বেজায় ক্ষুব্ধ তা বুঝিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। দাঁড়িয়ে পড়েন মঞ্চের পাশে। মাইকে তখন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুভাষ সরকারকে ঘোষণা করতে শোনা যায়, ‘‘আপনারা শান্ত হন, এটা সরকারি অনুষ্ঠান। স্লোগান দেবেন না।’’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। মুখ্যমন্ত্রীকে হাত জোর বোঝানোর চেষ্টা করেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। কিন্তু মমতা কোনওকিছুতেই মঞ্চে উঠতে রাজি হননি। একটা সময় এমন মনে হয় যে, মুখ্যমন্ত্রী অনুষ্ঠানে যোগই দেবেন না। তবে শেষ পর্যন্ত রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস মমতাকে বোঝান। তাঁর অনুরোধে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে রাজি হলেও মঞ্চে আর ওঠেননি মুখ্যমন্ত্রী। 

মঞ্চে উঠলেন না মমতা

মঞ্চের পাশে প্ল্যাটফর্মে রাখা চেয়ারে বসেই গোটা অনুষ্ঠানের কার্যক্রমে অংশ নেন। ওই জায়গায় দাঁড়িয়েই বক্তব্য রাখেন মুখ্যমন্ত্রী। বক্তব্যে অবশ্য জয় শ্রীরাম প্রসঙ্গ আর টানেননি মুখ্যমন্ত্রী। সদ্য মাতৃবিয়োগ হওয়া প্রধানমন্ত্রীকে সমবেদনা জানান। এই মঞ্চ থেকেই উদ্বোধন হয় পার্পল লাইন জোকা-বিবাদি বাগ মেট্রোর জোকা-তারাতলা অংশের। এ প্রসঙ্গে মমতা বলেন, তিনি রেলমন্ত্রী থাকাকালীন এই প্রকল্পের সূচনা করেছিলেন। ওই জায়গা থেকেই প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে সবুজ পতাকা নেড়ে বন্দে ভারত এবং জোকা-তারাতলা মেট্রোর যাত্রাশুরুর সঙ্কেত দেন। 

শুভেন্দুর তোপ 

পরে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব বলেন, মুখ্যমন্ত্রীকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাঁর মঞ্চে না ওঠার মতো কোনও কারণ ছিল না। মঞ্চে উঠতেই পারতেন। তবে তিনি যোগ দিয়ে অনুষ্ঠানের গরিমা বাড়িয়েছেন। রাজ্যের গেরুয়া শিবির আরও চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করেছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘উনি আমার সঙ্গে এক মঞ্চে বসবেন না বলে নাটক করেছেন। তেমন হলে অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়ে চলে যেতে পারতেন। তা করলেন না। উল্টে জোকা-বিবাদি বাগ মেট্রো যে তাঁর সময়ে শুরু হয়েছিল, সেটা শুনিয়ে গেলেন। আসলে নন্দীগ্রামে হারের জ্বালা ভুলতে পারছেন না। তাই এই নাটক করছেন।’’ 

বাঁদরামি, কটাক্ষ তৃণমূলের

রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের কেউ বলছেন, অসভ্যতা, কেউ সরাসরি বাঁদরামি বলে কটাক্ষ করেছেন। দলের বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায় বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীকে নিমন্ত্রণ করে তাঁর সামনে এমন স্লোগান দেওয়া অসভ্যতা।’’ রাজ্যসভার সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় বলেন, ‌‘‘ভারতবর্ষে কোনও রাজনৈতিক দল ধর্মীয় চরিত্র রাজনীতিতে ব্যবহারও করেনি, তাঁকে নিয়ে স্লোগানও করেনি। এটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রাজনৈতিক স্লোগান রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তো দেওয়া হচ্ছেই, পাশাপাশি সরকারি কর্মসূচিতেও এই স্লোগান তুলছেন।’’ এর পরই বাঁদরামি খোঁচা দেন সুখেন্দু। তাঁর কথায়, ‘‘যারা বাঁদরামি করে এবং প্রধানমন্ত্রীর সামনে ইতিমধ্যেই বাঁদরামি করার রেকর্ড রেখেছে, তারা রেলমন্ত্রীর সামনে বাঁদরামি করবে না, এই গ্যারান্টি কোথা থেকে পাবেন। রেলমন্ত্রী ভদ্রলোক। তিনি জানেন না, বাংলার লেজবিহীন বাঁদরগুলো কী ধরনের আচরণ করে। তিনি ভদ্রলোক বলে হাত জোর করে অনুরোধ করেছেন এবং তার জবাব তিনি পেয়েছেন যে, তার পরেও বাঁদরামি বন্ধ হয়নি।’’ দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘রাম তো ভগবান। রামকে রাজনীতিতে ব্যবহার করছেন কেন? রাম স্লোগান দিন। কিন্তু তার সঙ্গে বন্দে ভারতের যোগ কোথায়? শুভেন্দু দু’দিনের যোগী। দুবছর আগেও বলেছেন বিজেপি হঠাও দেশ বাঁচাও। এটা পুরোপুরি অসভ্যতা।’’ 

পদ্মেই ভিন্ন সুর

বিজেপি শিবিরেও আবার জয় শ্রীরাম স্লোগান নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। দলের নেতা ও প্রাক্তন সাংসদ সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া এই স্লোগান সমর্থন করেননি। চার্লস নন্দী আরও এক ধাপ এগিয়ে টুইটারে লিখেছেন, ‘‘বন্দে ভারতের সূচনা অনুষ্ঠানে কিছু মানুষের অপরিণত জয় শ্রীরাম স্লোগানে লাইনচ্যুত হয়ে গেল প্রধানমনন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়নের ট্র্যাক লাইনচ্যুত হয়ে গেল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চে উঠতে অস্বীকার করলেন। ২০২১-এর ভোটের আগে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে অনিয়ন্ত্রিত স্লোগান আমাদের বিপক্ষে গিয়েছিল।’’

ফিরল ভিক্টোরিয়ার স্মৃতি

হাওড়া স্টেশনে জয় শ্রীরাম স্লোগান উঠতেই ফ্ল্যাশব্যাকে উঠে এসেছে ২০২১-এর স্মৃতি। রাজ্যে বিধানসভা ভোটের আগে ২৩ জানুয়ারি নেতাজি জন্মজয়ন্তীতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মঞ্চে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ওই অনুষ্ঠানেও মুখ্যমন্ত্রীর সামনে দর্শকাসন থেকে ভেসে আসে জয় শ্রী রাম ধ্বনি। তাতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন মুখ্যমন্ত্রী। অনুষ্ঠান ত্যাগ না করে মঞ্চেই প্রতিবাদ করেন। বলেন, সরকারি অনুষ্ঠানের একটা শিষ্টাচার থাকা উচিত। 

ভবিষ্যতে সাবধানী হবেন মুখ্যমন্ত্রী? 

ফের একই ঘটনা। এবং এবারও প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু ঘটনাচক্রে মাতৃবিয়োগের জন্য সশরীরে আসেননি মোদী। ভার্চুয়ালি যোগ দিয়েছেন। কিন্তু এই স্লোগানে মঞ্চে উপস্থিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও বেজায় অস্বস্তিতে পড়ে যান। অন্য দিকে বারবার একই ঘটনা ঘটায় কার্যত স্তম্ভিত মমতাও। ফলে এর পর কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে কি আরও সাবধানী পা ফেলবেন মুখ্যমন্ত্রী। সম্মতি দেওয়ার আগে আরও দু’বার ভেবে দেখবেন? সেই প্রশ্ন কিন্তু এখন থেকেই উঁকি দিচ্ছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মধ্যে। 

মুখ পুড়ল মোদীরই?

আবার রাজনৈতিক মহলের একাংশ এমনও মনে করছেন, এটা মমতার অপমান নয়, কার্যত প্রধানমন্ত্রী মোদীরই অপমান। কারণ, তিনিই অনুষ্ঠানের প্রধান। মূল আকর্ষণ তাঁকে ঘিরেই। রেল মন্ত্রক আমন্ত্রণ করলেও মন্ত্রিসভারও তিনিই প্রধান। ফলে আমন্ত্রিত অতিথিরা কেউ অপমানিত বোধ করলে তার দায় প্রধানমন্ত্রীর উপরেও খানিকটা বর্তায় বটে। অনুষ্ঠানের গরিমা, শিষ্টাচার নষ্ট হলে তার দায়ভারও কি তাঁর উপরেও বর্তায় না?